বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিনেমাকে হার মানানো কাহিনি

পুলিশ পরিদর্শক হত্যায় জেল খাটেন ভুয়া আসামি, প্রকৃত আসামির খোঁজ দুবাইয়ে

মাহবুব মমতাজী

সিনেমাকে হার মানানো কাহিনি

রবিউল ইসলাম

পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার অভিযোগে জেল খাটেন এক ভুয়া আসামি। প্রকৃত আসামি পালিয়ে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। সেখানে তার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার একটি জুয়েলারি শপের অনুষ্ঠানে জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে গতকাল অংশ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।

২০১৮ সালের ৯ জুলাই রাজধানীর বনানীতে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খান। এ ঘটনায় বনানী থানায় মামলা হলে হত্যায় আটজনের সংশ্লিষ্টতা পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এদের মধ্যে পলাতক ছিলেন রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদি। তার বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, তাকে গ্রেফতারে ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি, ২৩ এপ্রিল, ১ জুলাই, ২৫ জুলাই এবং ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন হৃদয়। প্রায় পাঁচ মাস জেলে থাকার পর হৃদয় পরিচয় দিয়ে আত্মসমর্পণ করা ওই ব্যক্তি নিজেকে আবু ইউসুফ বলে দাবি করেন। ২০২১ সালের ২ মার্চ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত প্রতিবেদনের পর প্রায় ৯ মাস জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পান ইউসুফ। পরে অনুসন্ধানে জানা যায়, যোগসাজশে প্রকৃত আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে হৃদয়ের পরিবর্তে জেলে যান চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আইনপুর গ্রামের নুরুজ্জামানের ছেলে আবু ইউসুফ লিমন। ক্রিকেট খেলার স্বপ্নে বিভোর ইউসুফ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার প্রলোভনে হৃদয়ের পরিবর্তে হত্যা মামলার হাজিরা দিতে আদালতে যান। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ডিবির একটি সূত্রের ক্লু ধরে বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। এসবে জানা যায়, কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম ওরফে হৃদয় নিজের নাম বদলে রেখেছেন আরাভ খান। এই আরাভ খানই পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলার পলাতক আসামি। ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি দুবাইয়ে কয়েক বছর ধরে অবস্থান করছেন। তার পাসপোর্ট নম্বর ইউ ৪৯৮৫৩৮৯। শুধু আরাভ খানই নন, তার স্ত্রী সাজেমা নাসরিন এবং কথিত বাবা-মায়ের পাসপোর্টও ভারতীয়।

যেভাবে বেরিয়ে আসে জালিয়াতি : ইউসুফের আইনজীবী ও ডিবি পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলে যাওয়ার কিছুদিন পর ইউসুফ দাবি করা এই ব্যক্তি আদালতকে জানান তিনি হৃদয় নন। তিনি টাকার বিনিময়ে এবং পরিবারের ভরণপোষণ চালানোর চুক্তিতে হৃদয় সেজে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু হৃদয় চুক্তি অনুযায়ী কিছুদিন পর ইউসুফের পরিবারের খরচ চালানো বন্ধ করে দেন। পরে ইউসুফ প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে আদালতে জামিন আবেদন করেন। এরপর আদালত বিষয়টি তদন্ত করতে ডিবিকে নির্দেশ দেন। আর ডিবির প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে এই ইউসুফ আসলে হৃদয় নন। ডিবির প্রতিবেদন জমা হওয়ার পরই ইউসুফের জামিন হয়ে যায়।

আরাভ খানের ভারতীয় পাসপোর্টের তথ্যে তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুরে। কথিত বাবা জাকির খানের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে কন্দর্পপুর, রাজপুর সোনারপুর (এম), গড়িয়া, দক্ষিণচব্বিশ পরগনা। মা রেহানা বিবি খান।

যা ছিল ডিবির তদন্তে : আদালতে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে ডিবি উল্লেখ করেছে, তারা আবু ইউসুফের নাম-ঠিকানা, পিসিপিআর, জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, উচ্চবিদ্যালয়ের সত্যায়িত প্রশংসাপত্রের কপি, পাসপোর্ট সাইজের ছবি, পুরো শরীরের থ্রিআর সাইজের ছবি, পরিবারের সঙ্গে তোলা গ্রুপছবি, ইউনিয়ন পরিষদের জন্মসনদ ও নাগরিক সনদ সংগ্রহ করে। এসব যাচাই করে দেখা যায়, ইউসুফের বাবা নুরুজ্জামান, মা হালিমা বেগম, গ্রাম আইনপুর, উপজেলা কচুয়া, জেলা চাঁদপুর। প্রকৃত পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে হৃদয়ের সঙ্গে যোগসাজশে তার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন এই ইউসুফ। তবে এর মাধ্যমে ইউসুফ ফৌজদারি কার্যবিধির অপরাধ করেছেন। ইউসুফ নকল আসামি, এটি জানিয়ে ২০২১ সালের ২ মে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় ডিবির মতিঝিল বিভাগ। ডিবির মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহিদুর রহমান রিপন গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলার আসামি রবিউল ফেসবুক আইডি চালাচ্ছেন আরাভ নামে। তার ভারতীয় পাসপোর্ট আমাদের কাছে এসেছে। তার বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। ইন্টারপোলের মাধ্যমে পাসপোর্টের ব্যবহার করা ভারতীয় নাম-ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য চিঠি লিখব। আর অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।’

গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আরাভ খানের প্রোফাইলে ঢুকে দেখা যায়, সেখানে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। ভিডিওতে সাকিব আল হাসান বলছেন, ‘ওয়ার্ল্ড ফেমাস গোল্ড মার্কেট প্যালেস দুবাইয়ে আমি আসছি সাকিব আল হাসান, আসছি ১৫ মার্চ। আরাভ জুয়েলারি শপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।’ ফেসবুকে দুবাই গোল্ড ছোকে আরাভ জুয়েলার্সের গ্র্যান্ড ওপেনিংয়ে অভিনেত্রী দীঘির উপস্থিতির কথাও জানানো হয়েছে।

২০২১ সালে প্রথম যখন ভুয়া আসামির জেল খাটার বিষয়টি আলোচনায় আসে, তখন চাঁদপুরের কচুয়ার পরিবার পরিকল্পনা অফিসে কর্মরত আবু ইউসুফের বাবা নুরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘২০২০ সালে রবিউল ইসলাম আপন নামের এক ব্যক্তি আমার নম্বরে ফোন দিয়ে বলে, আপনার ছেলে বিকেএসপিতে আছে। আপনারা চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলে ডিসেম্বরের মধ্যে বাড়িতে চলে আসবে। কিছুদিন পর খবর পেয়ে ছেলের সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারে দেখা করি। তার কাছ থেকে জানতে পারি লিমনকে হত্যার হুমকি ও টাকার লোভ দেখিয়ে কোর্টে পাঠায় রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে হৃদয়। আদালতে লিমন নিজেকে রবিউল হিসেবে পরিচয় দেয়। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। ছেলের মুক্তি চেয়ে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করি। আদালত আবেদনটি আমলে নিয়ে ডিবি পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে বদলি সাজা খাটার চাঞ্চল্যকর এ তথ্য।’

পুলিশ বলছে, ২০১৮ সালে মামুন এমরান খানকে হত্যার পর পেট্রোল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরে বনের ভিতরে ফেলে দেয় দুষ্কৃতকারীরা। ওই ঘটনায় করা মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এরপর ঢাকার ১ নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু হয়। রবিউল ওরফে হৃদয় মগবাজারের নয়াটোলার আমবাগান এলাকা থেকে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। রমনা মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র আইনে মামলা হয়। জেলে পাঠানোর পর তিনি জামিনে বের হন। দুই বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ২৫ জুন আবারও অবৈধ অস্ত্রসহ তাকে গুলশান থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। জেলে পাঠানোর পর আবারও জামিনে বেরিয়ে যান তিনি। পরের বছর পরিদর্শক মামুন এমরান খানকে হত্যা মামলার আসামি হয়ে পলাতক থাকেন হৃদয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর