শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

হুমকিতে ঢাকার চার নদী

♦ কাজে আসছে না উচ্ছেদ অভিযান ♦ ফের গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবন, ট্রাকস্ট্যান্ড ♦ সীমানাপ্রাচীরও ঢেকে গেছে বালুতে ♦ পানিতে ভয়াবহ দূষণ

শামীম আহমেদ

হুমকিতে ঢাকার চার নদী

বছর চারেক আগে জোরেশোরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান, নদীর তলদেশ থেকে বর্জ্য অপসারণ এবং বড় বাজেটে নদীর পাড়ে স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করেও বাঁচানো যাচ্ছে না ঢাকার চার নদীকে। আবারও অস্তিত্ব সংকটে রাজধানীর ধমনিখ্যাত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী। জেঁকে বসেছে দখলদার। উদ্ধারকৃত নদীর জমিতে ফের গড়ে উঠছে আবাসিক ভবন, বালুর গদি, ট্রাকস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা। অনেক স্থানে বসানো সীমানা পিলারও ঢেকে গেছে বালুতে। নদীতে বাঁধ দিয়ে নতুন করে ভরাটও চলছে। চার নদীর পানি পরীক্ষায় মিলেছে ভয়াবহ দূষণের চিত্র। বিষে কালো নদীর পানিতে বিপন্ন মাছসহ অন্যান্য জলজপ্রাণী। গত এক সপ্তাহ সরেজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে।

২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকার চার নদী দখলমুক্ত করতে জোরেশোরে অভিযানে নামে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ২০২০ সালে এবং ২০২১ সালে করোনার মধ্যেও চলে অভিযান। প্রায় ৭ হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে উদ্ধার করা হয় নদীতীর। নদীগুলোর দূষণ ও তীরভূমি পুনর্দখল রোধে পরীক্ষামূলকভাবে ‘রিভার গার্ড’ ইউনিটও গঠন করে বিআইডব্লিউটিএ। তবে উদ্ধারকৃত নদীর জায়গার অনেক স্থান ফের বেদখল হয়ে গেছে। থামেনি দূষণও। শুধু গাবতলী থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত তুরাগের তীর দখল করে ১৩টি বাণিজ্যিক স্থাপনা, ৯টি আবাসিক ভবন, সাত স্থানে নতুন করে ভরাটের চিত্র নজরে এসেছে। এ ছাড়া ৯টি ফ্যাক্টরি, সাতটি বোটঘাট, ১১টি বালুর গদি, ১০টি বাস-ট্রাক স্টেশন ও পেট্রল পাম্প আংশিক দখল করেছে তুরাগের তীর। গাবতলী ব্রিজ থেকে সিন্নিরটেক পর্যন্ত পূর্ব পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হলেও রয়ে গেছে ভরাটকৃত মাটি। সেখানেই ফের চলছে দখল। পালপাড়া ঘাটের পরে নদীর অংশে দেখা গেছে ট্রাকস্ট্যান্ড। দিয়াবাড়ী থেকে চটবাড়ী পর্যন্ত নতুন করে ১৩টি বালুর গদি চোখে পড়েছে। চটবাড়ী থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত নদীর পাড়ে দেখা গেছে অসংখ্য বাণিজ্যিক স্থাপনা। এসব স্থাপনায় যাওয়ার জন্য পাউবোর সরকারি জায়গার ওপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। ২২টি সংযোগ সড়ক রয়েছে আবদুল্লাহপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত নদীর ফোরশোরে। আশুলিয়া থেকে ইজতেমা মাঠ পার হয়ে টঙ্গী খাল পর্যন্ত নদীর পাড় দখল করে আছে বিশ্ববিদ্যালয়, বাজারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব স্থানে একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও দখলমুক্ত হয়নি নদী। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানার ভিতরে ভরাট করে নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চিত্র চোখে পড়েছে। বালু ও বুড়িগঙ্গা নদীরও অনেক স্থান পুনর্দখল হয়েছে। এদিকে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) গেল শুষ্ক মৌসুমে দেশের বিভিন্ন নদীর পানি পরীক্ষা করে ৫৬টি নদীতে অতিমাত্রায় দূষণ খুঁজে পেয়েছে। জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া যায়নি বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যাসহ শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর নদীর পানিতে। আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশনা অনুযায়ী- পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) থাকতে হবে প্রতি লিটারে গড়ে ৬.৫ মিলিগ্রাম। অক্সিজেন ৫ মিলিগ্রামের নিচে নামলেই ঝুঁকিতে পড়ে জলজ জীববৈচিত্র্য। সেখানে বুড়িগঙ্গার প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ৮৫ মিলিগ্রাম, তুরাগে ১.১ মিলিগ্রাম, টঙ্গী খালে শূন্য দশমিক ৪ মিলিগ্রাম, বালু নদীতে ১.৫ মিলিগ্রাম, শীতলক্ষ্যায় শূন্য দশমিক ৭৫ মিলিগ্রাম ও ধলেশ্বরীতে শূন্য দশমিক ৬২ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া পানির পিএইচ, বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) ও কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি) পাওয়া গেছে অনেক বেশি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা নিয়মিত নদীগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। দূষণ আগের চেয়ে বেড়েছে। তীরভূমি দখলও হচ্ছে। সরেজমিন বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীতে দেখা গেছে, কুচকুচে কালো হয়ে গেছে পানি। অনেক স্থানে পানির নিচ থেকে বুদবুদ করে উঠছে গ্যাস। স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে কারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত রঙিন পানি পড়ছে নদীতে। নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের গৃহস্থলি ও মানব বর্জ্যরে শেষ ঠিকানাও হচ্ছে নদী। নাকে রুমাল চেপে পার হতে হচ্ছে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা ও বালু নদী। গত বছরের তুলনায় দূষণ বেড়েছে শীতলক্ষ্যায়ও।

বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের ‘টুওয়ার্ডস অ্যা মাল্টি সেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার চার নদীতে দৈনিক ১১২ টন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, যার বড় একটি অংশ প্লাস্টিক ও পলিথিন। ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলা ওই সমীক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর ৪৩টি জায়গায় ১১ হাজার ৫৬৪ টন, শীতলক্ষ্যায় ৪৩ জায়গায় ৪৩ হাজার ১৮৩ টন, বালু নদের সাত জায়গায় ২ হাজার ১২ টন এবং তুরাগের ৩৬ জায়গায় ১৫ হাজার ৭৭১ টন বর্জ্য পাওয়া গেছে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে কোনো উপায়ে ঢাকার চার নদীসহ সারা দেশের নদ-নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালে হাই কোর্ট এক রায়ে তুরাগসহ দেশের সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দূষণ ও দখলমুক্ত করার নির্দেশনা দেন। রায়ে নদী রক্ষা কমিশনকে তুরাগসহ দেশের সব নদ-নদীর দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও উন্নয়নে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করা হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকার চার পাশের নদীগুলোর ৯০ ভাগ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। কিছু বাকি আছে। নতুন করেও দখল হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে নানা রকম বাধার কারণে ঠিকভাবে কাজ করা যায় না। বিআইডব্লিউটিএ ঢাকার নদীগুলোয় সীমানা পিলার ও ওয়াকওয়ে করে দিচ্ছে। তখন আর দখল হতে পারবে না। এই নদীগুলোর এখন বড় সমস্যা দূষণ। ঢাকার উত্তরের সব নদী-খাল থেকে শিল্পবর্জ্য এসে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু নদীর পানিকে বিষাক্ত করছে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আগে নদীগুলোর পানি পরিষ্কার করতে চেয়েছিলাম, পারিনি। ২০০৯ সালে নদীগুলোকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর পরিবেশ অধিদফতরের যে কাজ, তা তারা করেনি। বারবার বলেছি, চিঠি দিয়েছি। দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলোকে তারা চাপ দিলে শিল্পদূষণ বন্ধ হতো। ভাসমান বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রতিটা খালের মুখে অনেক আগেই জাল দেওয়ার কথা ছিল দুই সিটি করপোরেশনের। দক্ষিণ সিটি পরিকল্পনা করেছে, উত্তর সিটি কিছুই করেনি।

এদিকে দীর্ঘদিনের দখলে-দূষণে মৃতপ্রায় ঢাকার চার নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করে স্বচ্ছ পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নদীর দুই পাড় দৃষ্টিনন্দন করতে পাঁচ বছর আগে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর দুই পাড়ে ১০০ বছর মেয়াদি স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন, ওয়াকওয়ে, আরসিসি সিঁড়ি, বসার বেঞ্চ, মালামাল ওঠা-নামার জেটি, ইকোপার্ক, সীমানাপ্রাচীর, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, সবুজ বেষ্টনীসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। তবে কচ্ছপ গতিতে চলছে প্রকল্পের কাজ। ২০১৮ সালের জুলাই হতে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বন্যার কারণে পরবর্তীতে মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। এরপর বাড়ে আরও এক বছর। এখনো কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি খুবই কম। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চার নদী সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক শাহনেওয়াজ কবীর মিঠু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সব উচ্ছেদ করে কাজ করছি। সীমানা পিলার বসানোর পরও ওয়াকওয়ে করতে গেলে বাধা আসছে। কাগজপত্র নিয়ে এসে বলছে এটা তাদের পূর্বপুরুষের জমি। এসব ঝামেলা মেটাতে হচ্ছে। পুনর্দখলও হচ্ছে। এ ছাড়া অধিকাংশ কাজই শুষ্ক মৌসুমে করতে হয়। এ জন্য দেরি হচ্ছে। আশা করছি আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ হবে। ঢাকার চার নদী পুনর্দখল রোধে অভিযান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (ল্যান্ড অ্যান্ড এস্টেট) এ কে এম আরিফ উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুই বছর এক্সক্লুসিভ অভিযান চালিয়ে ঢাকার চার পাশের নদীগুলো মোটামুটি দখলমুক্ত করে ফেলেছি। এখন সীমানা পিলার ও ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। সীমানা পিলার স্থাপনের সময় অবৈধ স্থাপনা পেলে রিফ্রেসমেন্ট অভিযানের মাধ্যমে সব উচ্ছেদ করা হবে। অল্প কিছু অবৈধ স্থাপনা নিয়ে হাই কোর্টে মামলা আছে। এগুলো নিষ্পত্তি হলে অভিযান চালাব। বর্তমানে আমাদের নজর মেঘনা নদীতে। ওখানে নদী দখলের তৎপরতা শুরু হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর