মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

চট্টগ্রামে গ্যাসের ভয়াবহ সংকট

জ্বলছে না চুলা, চলছে না গাড়ি, বন্ধ উৎপাদন

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামজুড়েই গ্যাসের জন্য চলছে হাহাকার। ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাত শুরু হওয়ার আগে মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পর শুরু হয় সংকট। ফলে বাসাবাড়ি কিংবা খাবার হোটেলে কোথাও জ্বলছে না গ্যাসের চুলা। যে সব হোটেলে খাবার বিক্রি হচ্ছে তাতে পড়ছে দীর্ঘ লাইন। সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ ও শিল্পকারখানার উৎপাদন। বন্ধ রয়েছে ফিলিং স্টেশনের গ্যাস বিক্রি। রাস্তায় কমে গেছে গ্যাসচালিত যানবাহনের সংখ্যা। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন চট্টগ্রামবাসী।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী রইস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট সমাধান প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গতকাল দুপুর থেকে আবাসিক পর্যায়ে আংশিকভাবে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। আশা করছি গ্যাস পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পর্যায়ক্রমে শিল্পকারখানা ও অন্যান্য খাতে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে।’

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে শনিবার থেকে চট্টগ্রামের সিংহভাগ শিল্পকারখানা বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছেন মঙ্গলবারের মধ্যে শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবারহ শুরু হবে। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। দ্রুত গ্যাস সরবরাহ শুরু না হলেও বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হবেন।’ তবে কেজিডিসিএলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে মহেশখালী ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে একটি টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। ওই টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতের আগে সতর্কতার অংশ হিসেবে শুক্রবার রাতে মহেশখালীর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল দুটি গভীর সমুদ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর গত তিন দিন ধরে এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শনিবার সকাল থেকে শুরু হয় গ্যাসের জন্য হাহাকার। বন্ধ হয়ে যায় বাসাবাড়ির রান্নাবান্না। গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ হয়েছে অনেক হোটেল রেস্টুরেন্টও। যে খাবার হোটেলগুলো চালু রয়েছে সেগুলোতে দেখা দিয়েছে খাবারের সংকট। হোটেল-রেস্টুরেন্টে রয়েছে খাবারের জন্য লোকজনের দীর্ঘ লাইন। বেকারিগুলোতে জুটছে না বিস্কুট, পাউরুটি কিংবা অন্যান্য খাবার। নিরুপায় হয়ে অনেক বাসাবাড়িতে লাকড়ির চুলায় রান্নার কাজ সারছেন। গত তিন দিন ধরে গ্যাসনির্ভর শিল্প কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে পুরোপুরি ভাবে। গার্মেন্ট থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প কারখানার উৎপাদন থুবড়ে পড়েছে। কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে চট্টগ্রামের শিল্প খাত। বন্ধ হয়ে গেছে গ্যাসনির্ভর সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে ধস নেমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ফলে চট্টগ্রামে চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং। গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে পোশাক তৈরির কারখানা। এতে করে ক্ষতির মুখে পড়েছে পোশাক কারখানার মালিকরা।

গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রামের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো। তাই সিএনজিচালিত বেশির ভাগ টেক্সি, টেম্পো ও বাস চলাচল রয়েছে বন্ধ। এ অজুহাতে তেল দিয়ে চলাচল করা অন্য পরিবহনগুলো নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ আদায় করছে। শনিবার সকাল থেকে এলপি গ্যাসের দোকানে লেগেছে দীর্ঘ লাইন। বাড়তি দামেও অনেকে পাননি গ্যাসের সিলিন্ডার। গ্যাসের এমন সংকটের সময় কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে স্টোভ, ইনডাকশন চুলা ও রাইস কুকারের। দ্বিগুণ-তিন গুণ দামেও এসব চুলা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। নগরীর দামপাড়ার দেলওয়ার হোসেন বলেন, ‘লাইনের গ্যাস না আসায় শনিবার ৩ হাজার ১৫০ টাকা দিয়ে এলপি গ্যাসের একটি সিলিন্ডার কিনতে বাধ্য হই।’ একই ভাবে মির্জারপুলের লিয়াকত আলী বলেন, ‘লাইনের গ্যাস না থাকায় শনিবার থেকে হোটেল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছি। খাবার কিনতেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গাড়ি ভাড়াও দিতে হচ্ছে দ্বিগুণ।’ কেজিডিসিএলের গ্রাহক এবং সংযোগ রয়েছে ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি। শিল্প বাণিজ্য ও অন্যান্য খাতে সংযোগ রয়েছে ৪ হাজার ৩৫৩টি। এসব খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। যার সবটুকুই জোগান আসে মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল থেকে। ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতের আগে সতর্কতার অংশ হিসেবে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল দুটি গভীর সমুদ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ। যদিও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকার পর কিছুটা সময় কেজিডিসিএল রিজার্ভ থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

সর্বশেষ খবর