পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যাওয়ার আগে আগে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে গেল আন্দোলন ঠেকানোর জন্য। ব্ল্যাংক চেক এমন অজ্ঞতার সঙ্গে দেওয়া হলো যে এর বিচরণক্ষেত্র কোথায় হবে সেটিও কিন্তু বলা হয়নি। যার ফলে বাইরে থেকে চালকরা এই ছোট গাড়িগুলো নিয়ে রাজধানীতে ঢুকে গেল। এর মধ্যে সে সময় পুলিশ ছিল না। এই অবস্থা তখন কে সামাল দেবে? তখন র্যাডিকেল কিছু জিনিস এখানে হয়ে গিয়েছে। যার উত্তাপ আমরা এখন টের পাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের ট্রান্সপোর্টেশন গায়ে গতরে চালাচ্ছিলাম। গত ৫ আগস্টের আগে ট্রাফিক পুলিশ অন্তত নগরীর মোড়গুলোতে জনবল দিয়ে ম্যানেজ করত। যদিও এটি ঠিক না, কোনো সিস্টেম না। জনবল থাকলে একরকম হবে আর না থাকলে আরেক করম হবে-এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। পুলিশ কেন মোড়ে থাকবে? মূলত ট্রাফিক সিগন্যাল মানানোর জন্য আমাদের সড়কে সারা বছর পুলিশ থাকে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে মোড়ে না, পুলিশ থাকে সার্ভিলেন্সে। এর অর্থ আমরা ম্যানুয়ালি প্রাগঐতিহাসিক যুগের সিস্টেম দিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থা ম্যানেজ করছিলাম। এতে কোনো আধুনিকতা নেই। এজন্য গত ৫ আগস্ট পুলিশরা যখন চলে গেল তখন সবাই স্বাধীনতা চত্বর পেয়ে গেল। এটি একটি বিরাট পরিবর্তন। শামসুল হক বলেন, একটি উন্নত দেশে যেখানে আইনভিত্তিক গাড়ি চলে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেখানে এনফোর্সমেন্ট এমন হয় যে, কোনো জায়গায় ম্যানুয়ালি লাগে না- সবকিছুই হবে অটোমেটেড। কেউ যদি একে না মানে, তাহলে রিমোটলি তাকে স্যু করে ফেলা হবে। অন্য দেশগুলোতে এমনভাবেই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ হয়। আমাদেরও যদি এটি মানা হতো, তাহলে এখন পুলিশ থাকা আর না থাকার মধ্যে যে পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি- সেটি তখন হতো না। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যানবাহনের ক্ষেত্রে যখন কোনো নীতিনির্ধারণের কথা বলা হয় তার অর্থই হচ্ছে এটি একটি দেউলিয়াপনা। এর অর্থ ডাক্তার না হয়েও ডাক্তারের পরামর্শ যদি কেউ একজন কবিরাজ দিয়ে ফেলে, আর এটি যদি একদম উঁচুপর্যায় থেকে আসে- তাহলে এটি ক্ষতিকর হবে। আমি বলব যোগাযোগ খাত বেশ জটিল একটি খাত। এ জায়গায় আমাদের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি থেকে এই যে কথাগুলো চলে আসছিল, এর ফলে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা এখন বুক ফুলিয়ে সড়কে রিকশা চালাচ্ছে। এগুলোকে কেউ নিয়ন্ত্রণও করতে পারছে না।
এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, সড়ক সুশৃঙ্খল করতে গেলে এই অবৈধ গাড়ি, যার কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই, যে চালকের কোনো প্রশিক্ষণ নেই- তারা যদি আমাদের মহাসড়ক ও প্রধান সড়কে চলে এবং এটি যদি দেখার কেউ না থাকে, তাহলে এই শহর ও দেশকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। এই বিশৃঙ্খলা কাউকে না কাউকে দেখতে হবে। যেহেতু এগুলো দেখার লোক নেই, এক্ষেত্রে এটি যদি সংস্কার করা না হয়- সেক্ষেত্রে হয়তো আর্মি নামানো হবে। পুলিশকে আরও হেদায়ত দেওয়া হবে কিন্তু এভাবে কিছু হবে না। তিনি বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররা যে জায়গাটি তৈরি করেছে, তাতে এখনই পুলিশের সংস্কার করতে হবে। সড়কের মধ্যে যারা জড়িত বিশেষ করে বিআরটিএ- এটি একটি রেগুলেটরি অথরিটি। কিন্তু এই সংস্থাটি ভুল করেই যাচ্ছে। কারণ সেখানে কতগুলো আমলা আছে, যাদের পদ আছে, পদায়ন নেই। টেকনিক্যাল কাজের প্রধান হয়ে যে-ই আসছে, তারা তাকে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে দিচ্ছে। চলার ক্ষমতা আছে কি না তা যাচাই করা হচ্ছে না। আবার বাস, ট্রাককে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হচ্ছে কিন্তু চালক নেই। এজন্য তারা দায়ও নিচ্ছে না। ট্রান্সপোর্ট রিলেটেড রেগুলেটেড অথরিটি হিসেবে সে শুধু রেজিস্ট্রেশন দেবে না, অবৈধ কেউ ঢুকলে সেটি দেখাও তার দায়িত্ব। কিন্তু বিআরটিএ শুধু রেজিস্ট্রেশন দিয়ে টাকা উপার্জন করছে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে একজন ব্যবহারকারীর সঙ্গে তার যে কমিটমেন্ট তা রক্ষা করছে না। পুলিশও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে না। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ লজিস্টিক আমাদের হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। এখন সংস্কারের মাধ্যমে অর্পিত দায়িত্বগুলো পালন না করলে- কী করতে হবে সে জিনিসটা আসতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের টেকনিক্যাল শক্তিশালী বিভাগ না করলে এবং এসব ক্ষেত্রে টেকনিক্যালি একজন প্রধানকে দায়িত্ব না দিলে, আমরা যে নন টেকনিক্যাল আমলাদের পুনর্বাসন করছি- এসব জায়গার তার মাশুল আমাদের দিতে হচ্ছে।