চারশত বছরের পুরনো রাজধানী ঢাকাকে বসবাস উপযোগী, দৃষ্টিনন্দন ও নাগরিক সুবিধার আঁধারে পরিণত করতে এক যুগ আগে উদ্যোগ নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রণয়ন করা হয় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)। নানা জটিলতায় সেই উদ্যোগ পুরোপুরি আলোর মুখ না দেখায় বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা শহরের অবস্থান অতি নিম্নে। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে দুই থেকে তিনটি খেলার মাঠ, পার্ক, গণপরিসর, একটি বিদ্যালয় ও হাসপাতাল স্থাপনের মতো ভূরি ভূরি প্রস্তাব রয়েছে সংশোধিত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ)। অথচ ঢাকা শহরের এমন অনেক ওয়ার্ড আছে, যেখানে শুধুই গিঞ্জি জনবসতি। নেই খোলা জায়গা কিংবা খেলার মাঠ। এমনকি নেই হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তাঘাটও। এমন একটি শহরে কীভাবে হবে আধুনিক প্রকল্প ড্যাপের বাস্তবায়ন। ড্যাপ বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ, কর্মপরিকল্পনা ও জনঘনত্ব জোনিং নিয়ে সচিবালয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ড্যাপ রিভিউ মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তারই বিস্তারিত অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ড্যাপ বাস্তবায়নে মূল চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মো. তাজুল ইসলাম : যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নই এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পরিকল্পনা শতভাগ সফল বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী প্রণয়ন করেছে। ওই পরিকল্পনায় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত, পাবলিক স্পেস, নাগরিক সুবিধাদি, জনঘনত্ব জোনিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাবনা রয়েছে। সেই প্রস্তাবনাসমূহ সরকারি অন্যান্য সংস্থা যেমন সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক প্রকল্প গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে হবে। ড্যাপ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা সমভাবে অগ্রসর না হলে এটি বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। এছাড়া ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার জন্য রাজউককে সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যেমন- মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে সমন্বয়ে অবৈধ ভবন নির্মাণ রোধ এবং জলাশয় ভরাট রোধকল্পে নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ব্যবসায়ী সংগঠন পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবী সংগঠনসহ সব মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ড্যাপের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব। তাই এ সংক্রান্ত সব অংশীজনের (স্টেক হোল্ডার) সমন্বয়ে ড্যাপ বাস্তবায়নই বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আশা করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক দিকনির্দেশনায় সবার অংশগ্রহণে ড্যাপের বাস্তবায়ন হবে ইনশাল্লাহ।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ড্যাপ বাস্তবায়নে কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে?
মো. তাজুল ইসলাম : পরিকল্পনা প্রণয়নকালে যেমন জনসম্পৃক্ততা দরকার ঠিক তেমনি প্রণীত পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সবার সম্পৃক্ততা অতীব জরুরি। রাজউক কখনো এই প্ল্যান এককভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে না। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং সব ইউনিয়ন পরিষদ এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কার্যকর সমন্বয়ই পারে প্রণীত পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন। আর এই সমন্বয়ক হিসেবে রাজউককেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিকল্পনার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ বাস্তবায়নের প্রধান কৌশলসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ২০২২-৩৫ প্রস্তাবনাসমূহ থেকে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পের বাস্তবায়নের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম পাঁচ বছরে কোন কোন প্রকল্প কোন কোন সংস্থার সমন্বয়ে বাস্তবায়ন করা হবে তার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন : রাজউক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সমন্বয়ে ৬২৭টি স্কুল বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করতে হবে যার জন্য মোট ২৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট দরকার পড়বে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বয়ে ২৮৭টি হাসপাতাল নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। রাজউক, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ে নগর জীবনরেখার আওতায় ২৩টি খাল উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করতে হবে। রাজউক, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ে ৫টি আঞ্চলিক পার্ক, ২০টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, ৩টি ইকো পার্ক এবং ৪টি অন্যান্য পার্ক এবং খেলার মাঠ নির্মাণ করবে। রাজউক এবং স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ে শুধু নিম্নবিত্তের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন ব্যবস্থায় ১০টি এলাকা নির্মাণ করবে। রাজউক, স্থানীয় সরকার ডিটিসিএ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের সমন্বয়ে ২টি প্রধান সড়ক এবং ২টি রিং রোড এবং রিং রোডের সঙ্গে সংযুক্ত রেডিয়াল রোড এবং বৃত্তাকার নৌপথ নির্মাণ করা হবে। ড্যাপ বাস্তবায়নে রাজউক তার অন্তর্গত এলাকার সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে প্রতি ৬ (ছয়) মাস পর পর অন্তত একবার সমন্বয় সভা করবেন। ড্যাপে নির্দেশিত সুপারিশ অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে কিনা, এই সভা তার পর্যালোচনা করবে অথবা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাকে (২০২২-২০৩৫) আরও কার্যকর করতে এখানে নির্দেশিত সুপারিশসমূহের কোনো ধরনের পরিমার্জন বা পরিবর্ধন লাগবে কি না, সেই ব্যাপারে যৌক্তিক দিকনির্দেশনা দিবেন। বিশদ পরিকল্পনাকে কার্যকর এবং এর সফল বাস্তবায়ন করতে রাজউকের অধীনে ড্যাপ বাস্তবায়ন সেল গঠন করবে। এছাড়া পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে রাজউকের সমন্বয়ে ওয়ার্ড/ইউনিয়ন পর্যায়ে ড্যাপ বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করবে। প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-২০৩৫ প্রতি পাঁচ বছর পরপর এই পরিকল্পনাটি বাস্তবতার নিরিখে হালনাগাদ করতে হবে এবং তিন বছর আগে থেকেই হালনাগাদকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ন্যূনতম তিন বছর অন্তর অন্তর জনঘনত্ব ব্লকসমূহে নতুন সামাজিক সুবিধাদি যেমন- স্কুল, পার্ক, খেলার মাঠ, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিতে এলাকা ভিত্তিক FAR-এর মান বর্ণিত পদ্ধতিতে পুনর্নির্ধারণ বা পরিমার্জন করা হবে। ড্যাপ রিভিউ-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ড্যাপে নির্দেশিত সুপারিশ অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে কি না অথবা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাকে (২০২২-২০৩৫) আরও কার্যকর করতে এখানে নির্দেশিত সুপারিশসমূহের কোনো ধরনের পরিমার্জন বা পরিবর্ধন লাগবে কি না, সেই ব্যাপারে যৌক্তিক দিকনির্দেশনা দিবেন। পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে আগামী পাঁচ বছর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জনঘনত্ব জোনিং ঢাকার বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে কতটুকু জরুরি?
মো. তাজুল ইসলাম : ঢাকা শহরের জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ অনুমোদন করা হয়েছে, যা আগামীর ঢাকা মেগা শহরের জন্য পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার জন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মেগা সিটির পরিকল্পনা সব সময়ই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেখানে বিভিন্ন অংশীদারের বিবিধ অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সামাজিক প্রেক্ষাপট জড়িত থাকে। ঢাকা শহরও তার ব্যতিক্রম নয়। ড্যাপ পূর্ণাঙ্গভাবে অনুমোদন পাওয়ার পর অনুমিতভাবেই তা জনসাধারণ, অংশীজন ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই পরিকল্পনায় আধুনিক নগর পরিকল্পনার বিভিন্ন ধারণা সন্নিবেশ করা হয়েছে, যা বাসযোগ্য ঢাকা গড়তে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। অনুরূপভাবে এই পরিকল্পনা যদি কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে যা সার্বিক জনস্বার্থ ও জনকল্যাণ রক্ষায় বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা ও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। নগর পরিকল্পনায় আবাসিক ভবনের উচ্চতা ও আয়তন নগর এলাকা কিংবা জনবসতির বাসযোগ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। নগর পরিকল্পনার কৌশল অনুযায়ী, নগর এলাকার ধরন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, নির্দিষ্ট এলাকার জন্য প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা, সড়কের প্রশস্ততা, নির্দিষ্ট এলাকার পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য, খেলার মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা এবং জলাশয়ের উপস্থিতি, সামাজিক অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধার মতো বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়েই আবাসিক এলাকার ভবনের উচ্চতা ও আয়তন নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ভবনের উচ্চতা ও আয়তন নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধানত রাস্তার প্রশস্ততা ও প্লটের আকার বিবেচনায় নেওয়া হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ অনুসরণ করা হয় যেখানে ভবনের উচ্চতা আয়তন নির্ধারণের ক্ষেত্রে এফএআর কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৮-এর এই বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকার জন্য এফএআরের মান ৩.১৫-৬.৫ পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়েছে। যা ব্যক্তিগতভাবে প্লটভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের এফএআরের মানের বিবেচনায় অনেক বেশি। ঢাকা শহরের জমির মালিকানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছোট আয়তনের একটি, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুই থেকে পাঁচ কাঠা হয়ে থাকে। এ জন্যই ক্ষুদ্র নেটের নির্মাণের ফলে ঢাকা শহরের সর্বজনীন বাসযোগ্যতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নগর পরিকল্পনা কৌশলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নগর অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য আবাসনের ক্ষেত্রে সাধারণত স্বল্পমানের ‘এফএআর’ নির্ধারণ করা হয় এবং ব্লকভিত্তিক আবাসনের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি ‘এফএআর’ দেওয়া হয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন নগর এলাকার বৈশিষ্ট্য ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে দ্রুত সময়ের মধ্যে এলাকাভিত্তিক ‘এফএআর’ মান নির্ধারণ করা হবে। ব্লকভিত্তিক আবাসন উৎসাহিতকরণের জন্য প্রণোদনা। কেউ কেউ বলেন, এফএআরের মাধ্যমে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। তাঁরা হয়তো খেয়াল করেননি, এবারের ড্যাপে এফএআরের পাশাপাশি কাঠাপ্রতি পরিবার সংখ্যার বিষয়ে প্রস্তাবনা যুক্ত করা আছে। যা জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর পরিকল্পনার কৌশল। তবে এই পরিকল্পনাগুলোকে কার্যকর করতে হলে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদারকি ও পরিবীক্ষে হবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ঢাকা মহানগরীকে বসবাসযোগ্য ও টেকসই করে তুলতে এবং সামগ্রিক জনস্বার্থ নিশ্চিত করতে গঠনমূলক যে কোনো পরামর্শকে স্বাগত জানান হবে। শহর সর্বদা একটি জীবন্তসত্তা, এটা মাথায় রেখে সব সময়ই বৃহত্তর জনকল্যাণ নিশ্চিতে দায়বদ্ধ থেকেই পরিকল্পনা দর্শন পরিচালিত হওয়া উচিত। ভারবহুল ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ জনসংখ্যার ভার নিয়ে চলা এই ঢাকা মহানগরীর জনগণ, ভূমি এবং পরিবেশের সার্বিক কল্যাণই আমাদের মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাকে ধন্যবাদ।
মো. তাজুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।