ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ২০১৭ সালে সাবেক মন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি শাহজাহান খানের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়ে যান ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান।
ফরিদপুরের বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগ করে বলেন, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আব্দুর রহমানের মনে খায়েশ জাগে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হবেন। রাষ্ট্রের একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির এতো বছর পর মনে হয়েছে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হবেন এটা স্বাভাবিক বিষয় নয়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী এই নেতা ২০১৭ সালে ক্ষমতার বলে মুক্তিযোদ্ধা হন। ২০২১ সাল থেকে তিনি ভাতা ভোগী হন। আব্দুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং ০১২৯০০০৫৩৯৮, বেসামরিক গেজেট নং ৬৯১৭।
কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে তার নিজের এলাকা প্রকৃত পক্ষে যুদ্ধকালীন এলাকা থেকে আবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে তার যুদ্ধকালীন কমান্ডারসহ তিনজন সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। প্রাথমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন করবেন। এরপর উপজেলা থেকে যাচাই বাছাই শেষে কেন্দ্রে যাচাই বাছায়ের জন্য পাঠানো হয়। তারপর কেন্দ্র থেকে প্রতিনিধি এসে যাচাই বাছাই করে অনুমতি দেন। সেক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ের যাচাই বাছাই কমিটি শুধু সাক্ষী গ্রহণ করে লিপিবদ্ধ করা ছাড়া কোন কাজ থাকে না।
এখানে ভিন্নমত প্রকাশ অনেকটা সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। কারন যখন তার মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার যুদ্ধে অংশ নেওয়া আরো দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন সেখানে জেলা থেকে জানা অজানা বিষয়টি শুধু ধারাবাহিকতা।
মুজিব বাহিনীর যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর ওহাব বলেন, আব্দুর রহমান একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। ২০১৭ সালে মধুখালী থেকে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে প্রভাব খাটিয়ে পাশের উপজেলা বোয়ালমারীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন ও আবুল ফয়েজ শাহনেওয়ারজের মাধ্যমে এই অপকর্ম করেন। এছাড়া রহমান কেন্দ্রের অর্থাৎ ঢাকার সাহায্য নেন। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ইউএনওকে ব্যবহার করে তিনি সকল প্রক্রিয়া শেষ করেন। তিনি কোন যুদ্ধ করেননি। আর তাকে যে প্রক্রিয়া করে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে তার সবই মিথ্যা ও বানোয়াট।
ফরিদপুর জেলা থেকে যাচাই বাছাই কমিটির সভাপতি সাবেক জেলা কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আবুল ফয়েজ শাহ নেওয়াজ বলেন, আমি যাচাই বাছাই কমিটির সাত সদস্যের একজন ছিলাম। আসলে জেলা থেকে যাচাই বাছাই কমিটি বলা হলেও আমাদের কাজ ছিল সাক্ষীদের বয়ান লিপিবদ্ধ করা। আবেদনকারী আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমানের পক্ষে বোয়ালমারী উপজেলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিনসহ তিনজন সাক্ষী দেন। আমরা শুধু সাক্ষীদের বয়ান ও আবেদনকারীর বয়ান লিপিবদ্ধ করেছি। তারা আব্দুর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রে দায়িত্বে ছিলেন শাহজাহান খান। তিনি নিজে এসে বিষয়টি নিয়ে শুনানি করে আব্দুর রহমানের পক্ষে প্রতিবেদন দেন।
আবুল ফয়েজ বলেন, এর আগে আব্দুর রহমান আমাকে একাধিক বার ফোন করে তার পক্ষে থাকার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি বলেছি, আপনার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও সাক্ষীরা যা বলবে তা-ই হবে। এখানে আমার কোন কাজ নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে ফয়েজ বলেন, স্বাধীনতার এতো বছরে শুনিনি তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বা তিনিও কখনও বলতেন না। হঠাৎ করে আবেদন করেন। তারপর তৎকালীন ইউএনও সাহেব উদ্যোগ নিয়ে বাকি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেন।
সাবেক সাংসদ ও মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা শাহ মোহম্মদ আবু জাফর বলেন, আব্দুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিল বিষয়টি আমি জানি না। এছাড়া তিনি আর কোন মন্তব্য করেননি।
মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা কবিরুল আলম মাও বলেন, স্বাধীনতার এতো বছর পর আব্দর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয়টি আমার কাছে বোধগম্য নয়। তিনি সচেতন মানুষ। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হলে এতো দেরি করলেন কেন? তৎকালীন ইউএনও কথা শুনেছি তিনি উদ্যোগী হয়ে নাকি সব করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ও আব্দুর রহমানের প্রধান সাক্ষী আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, আব্দুর রহমান ৭১ ছাত্র ছিলেন। তিনি ভারতে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিং এর জন্য গিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি রানাঘাটে অবস্থান করেন এবং যুদ্ধ শেষ হলে দেশে ফিরে আসেন। যেহেতু ট্রেনিং নিয়েছেন সেই কারণে তাকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া দুজন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ও আব্দুর রশিদ সাক্ষ্য দেন তারা আব্দুর রহমানকে ভারতে দেখেছেন।
মো: আব্দুর রহমান ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। শেখ হাসিনার পঞ্চম মন্ত্রীসভায় মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। আব্দুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কামালদিয়া গ্রামে। তার পিতা মো. শরিয়তউল্যা ও মাতা আয়েশা শরিয়তউল্যা। তিনি ফরিদপুর সরকারি ইয়াছিন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
২০০৮, ২০১৪ ও ২০২৪ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করলে তিনি সংসদ সদস্য পদ হারান। সূত্র: বার্তা ২৪
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন