চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চেকআপ করলে ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো জটিল অনেক রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব। এসব রোগে আক্রান্ত হবার ঘটনাটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লেও তা নিরাময় ঘটানো সম্ভব। কারণ, এখন এসব রোগের চিকিৎসা নিয়ে কোনো সংকট নেই যুক্তরাষ্ট্রে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি (এনওয়াইইউ)’র কম্যুনিটি হেলথ ফোরাম এবং ইন্ডিয়া হোমসের যৌথ উদ্যোগে গত সোমবার জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষভাবে অভিজ্ঞরা এ কথা বলেন।
গবেষণামূলক বক্তব্যে তারা আরো জানান, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মধ্যদিয়েও নিজেকে রোগমুক্ত রাখা সম্ভব। শরীরের ওজন যাতে না বাড়ে সেদিকে যত্নবানরা দীর্ঘজীবি হচ্ছেন। আর জটিল সব রোগে আক্রান্তদের সিংহভাগই গুরুতরভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ সময় নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘ইন্টারনাল মেডিসিন এক্সপার্ট’ এবং বাংলাদেশি আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশনের প্রথম নারী সেক্রেটারি ডা. বর্ণালী হাসান উল্লেখ করেন, বারবার উপদেশ/পরামর্শ উপেক্ষা করে আমার কয়েকজন রোগী কঠিন সংকটে নিপতিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তারা আরোগ্য লাভ করলেও অনেক ধকল সইতে হয়েছে।
প্রিয়ভাষী ডা. বর্ণালী উল্লেখ করেন, ঠিকমত চলাফেরা করছেন, শরীরের ওজনও বেশী নয়, এটাই সুস্থতার গ্যারান্টি হতে পারে না। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টেস্ট করা জরুরী। তাহলে অনেক রোগই প্রাথমিক স্তরে ধরা পড়লে তা পুরোপুরি নিরাময় ঘটানো সহজ হয়।
মাসালা (দ্য মেডিয়েটর্স অব অ্যাথিরোসক্লিরোসিস ইন সাউথ এশিয়ান্স লিভিং ইন আমেরিকা) স্টাডিজের অ্যাসোসিয়েট রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর সংগঠক সাবিহা সুলতানা বলেন, বাংলাদেশী তথা দক্ষিণ এশিয়ান আমেরিকানদের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা নিয়ে এনওয়াইইউ এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোর এই গবেষণা-পর্যবেক্ষণ চলছে দেড় দশক আগে থেকে। প্রবীন প্রবাসীদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষার আলোকে ২০২১ সালে এনওয়াইইউ পরিচালিত জরিপে টার্গেট ছিল ৮৫০। সে স্থলে অংশ নেন ৭৫৪ জন। ৬০০ বাংলাদেশীর স্থলে পাওয়া যায় ৫৭০ জন। এর ৪৯% পুরুষ ছিলেন। সেই জরিপে উদঘাটিত হয় যে, বাংলাদেশী প্রবীনদের ৪১.৮% ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ৬২.২%। অস্বাভাবিক ওজন ৫০.২% এর। পাকিস্তানীদের মধ্যে এ হার ৫৫.৬% এবং ভারতীয়র ৩০%। অর্থাৎ নিজেকে সুস্থ রাখতে দক্ষিণ এশিয়ার এ তিন দেশের অভিবাসীর মধ্যে সবচেয়ে সচেতন হচ্ছেন ভারতীয়রা। করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্য এগিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশীরা, এ হার ৯৯.৪%। পাকিস্তানীদের মধ্যে এ হার ৯৭.৮%। দীর্ঘ ১৪ বছরের এ গবেষণায় তহবিল জুগিয়েছে এনআইএইচ (ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ)-২১ মিলিয়ন ডলার। প্রাইভেট সেক্টর থেকেও এসেছে ১.২৫ মিলিয়ন ডলার। এনওয়াইইউ-তে এশিয়ান আমেরিকানদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ‘কম্যুনিটি হেলথ ওয়ার্কার’ হিসেবে কর্মরত সাবিহা আরো জানান যে, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি গবেষণা জরিপে এখনও পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন ২৩০০ জন।
সাবিহা উল্লেখ করেন, চলমান গবেষণা-জরিপ আলোকে ইতিমধ্যেই ১১০টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ চিকিৎসা সম্পর্কিত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে-যার সুফল আসছে সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থায়।
এই প্রকল্পে এনওয়াইইউ’র সহযোগী পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ডিপার্টমেন্টের সহকারি অধ্যাপক ড. নাদিয়া ইসলাম বলেন, ড্রিম (দ্য ডায়াবেটিস রিসার্চ, এডুকেশন, অ্যান্ড অ্যাকশন ফর মাইনোরিটিজ) প্রজেক্ট’র মাধ্যমে নিউইয়র্ক অঞ্চলের প্রবাসী বাংলাদেশীদের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। তবে এখনো অনেকে নিজের সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হননি বলে প্রতিনিয়ত জটিল রোগে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন অবস্থার অবসানে নিজ ভাষা ও সস্কৃতির আবহে চিকিৎসা-সেবার পরিধি বিস্তৃত করার প্রয়াস চলছে। এতে যতোবেশী সাড়া পাবো তত সুবিধা হবে গবেষণা এবং চিকিৎসা-ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো। ডেন্টিস্ট আইনুন নাহার সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন খাদ্যাভাস পরিবর্তনের।
কর্মশালার সমন্বয় এবং অংশগ্রহণকারি প্রবীন প্রবাসীগণকে প্রদত্ত বিভিন্ন সেবামূলক ব্যবস্থার তথ্য অবহিত করেন কম্যুনিটির অসহায় মানুষের সেবায় দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত নাহার আলম। তিনি জানান, এই গবেষণা প্রকল্পে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালে অংশগ্রহণকারি ৩০৩ প্রবাসীর মধ্যে ৬৮% এর উচ্চ রক্তচাপ কমানো সম্ভব হয়েছে। নিয়মিতভাবে ব্যায়াম এবং খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনলে অনেক জটিল রোগ থেকে পরিত্রাণ লাভ করা সহজ হয়।
কর্মশালা থেকে আরো জানানো হয় যে, আগে ৫০ বছর বয়স হলেই চিকিৎসকেরা কলোন ক্যান্সার টেস্টের তাগিদ দিতেন। এখন তা কমিয়ে ৪৫ বছর করা হয়েছে। জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে নাহার আলম জানান, দক্ষিণ এশিয়ানরাও কলোন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন টেস্ট করা জরুরী।
এই প্রকল্পে অন্যতম সহযোগী ইন্ডিয়া হোমসের পক্ষ থেকে প্রবীন প্রবাসীদের আবাসস্থল নির্মাণের তথ্য জানানো হয়। এগুলো স্বল্প ভাড়ায় ব্যবহার করতে পারবেন বাংলাদেশীরাও। গৃহায়নে সহযোগিতার এসব প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হতে আরো দু’বছর লাগবে বলেও উল্লেখ করেন সাবিহা সুলতানা।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারিরা নিজ নিজ অভিজ্ঞতা উপস্থাপনকালে জীবন-যাপনে অনেকটা স্বাচ্ছন্দবোধ করছেন বলে উল্লেখ করেন। এ সময় নাহার আলমের নেতৃত্বে সকলে কয়েক মিনিট শরীর চর্চায় অংশ নেন আনন্দচিত্তে। কর্মশালা সমন্বয়ে আরো ছিলেন এই প্রকল্পের কর্মী উইলি নন্দি, সুমি, মোর্শেদা প্রমুখ।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল