শনিবার, ১১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

গুগলের প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার বাংলাদেশের জাহিদ

তানিয়া তুষ্টি

গুগলের প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার বাংলাদেশের জাহিদ

স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় বরাবরই প্রথম হতেন।

অথচ এই ছেলের ক্লাসে রোল থাকত একদম নিচের দিকে। এর কারণ হলো, মুখস্থ বিদ্যায় তিনি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তবে ‘ও’ লেভেলে রেজাল্ট ভালো করেছিলেন। কিন্তু ‘এ’ লেভেলে খুব খারাপ করে ফেলেন। রেজাল্ট এমন হয় যা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াও সম্ভব ছিল না।

 

গুগলের জুরিখ ক্যাম্পাসে প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন পটুয়াখালীর ছেলে জাহিদ সবুর। ২০০৭ সালে তিনি প্রথম গুগলে যোগ দেন। ব্যাকঅ্যান্ড সিস্টেম নিয়ে ছিল তার প্রথম প্রকল্প। সেই প্রকল্পের কাজ ছিল গুগল প্রদত্ত সার্ভিসগুলোর উন্নত ও বিস্তৃত করা। প্রোগ্রামিংয়ে পারদর্শিতার কারণে তিনি খুব দ্রুতই সমস্যার সমাধান বের করে কোড করে ফেলতেন। আর তাই তার ম্যানেজারও বেশির ভাগ কঠিন কাজের সমাধান পেতে ভরসা করতেন জাহিদের ওপর। এভাবে নিজের পারদর্শিতা দেখাতে দেখাতে একসময় বড় বড় সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পেয়ে গেলেন। আর বর্তমানে তিনি গুগলের কোড বেইজে এক নম্বর ইঞ্জিনিয়ার পদে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন।

 

জাহিদ সবুরের বাবা অধ্যাপনা করতেন সৌদি আরবের কিং ফয়সাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই সূত্রে তার জন্ম সৌদি আরবে। আট বছর বয়সে তার পরিবার দেশে ফিরে আসে। তখন জাহিদকে ভর্তি করানো হয়েছিল মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে তিনি চলে যান অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ব্যাডমিন্টন আর ক্রিকেট খেলা পছন্দের থাকলেও ইলেকট্রনিক্স বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল অনেক। সার্কিট বানাতেও শিখে গিয়েছিলেন ওই ছোট্ট বয়সে। পড়াশোনায় বেশ উদাসীন এই ছেলে মন দিয়ে শুধু সার্কিট বানিয়ে গেছেন। ছেলের এমন খেয়ালিপনায় মা বরং উৎসাহ দিয়েছেন। মার্কেটে নিয়ে গিয়ে ইলেকট্রনিক পার্টস খুঁজে দিয়েছেন। শুধু সার্কিট বানানো নয়, স্কুলে পড়ার সময় তিনি অনেক বইও পড়ে নিয়েছেন। বাড়িতেই তার বড় বোনের নিজস্ব একটা লাইব্রেরি ছিল।

 

সার্কিট বানানোর ঝোঁকে মত্ত থাকা ছোট্ট জাহিদ অনেকবার ইলেকট্রিক শক খেয়েছেন। পরবর্তীতে মায়ের পরামর্শে একটা কোর্স করে নেন। এরপর আর ঠেকায় কে? স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় বরাবরই প্রথম হতেন। অথচ এই ছেলের ক্লাসে রোল থাকত একদম নিচের দিকে। এর কারণ হলো, মুখস্থ বিদ্যায় তিনি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তবে ‘ও’ লেভেলে রেজাল্ট ভালো করেছিলেন। কিন্তু ‘এ’ লেভেলে খুব খারাপ করে ফেলেন। রেজাল্ট এমন হয় যা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াও সম্ভব ছিল না। অপরদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ জোগানো তার জন্য কঠিন ছিল। তাই কম্পিউটার বিষয়ে কোর্স করে নিলেন। সেখন থেকে ইন্টারনেট আর নেটওয়ার্কিংয়ে দক্ষতা গড়ে উঠল দ্রুতই। তারপর টেক উদ্যোক্তাদের মতো একটি বিজনেস প্ল্যান দাঁড় করিয়ে ফেললেন। সে সময় গ্রামীণ সাইবারনেট ছিল দেশের বড় আইএসপিগুলোর একটি। হঠাৎ একদিন তাদের ডোমেইনের মালিকানা ও ডিএনএস কনফিগারেশন ট্রান্সফার হয়ে গেল জাহিদের কাছে। তাদের ব্যবহারকারীদের সব ই-মেইল আসা শুরু হলো তার কাছে। জাহিদ তখনো জানেন না গ্রামীণ সাইবারনেটের সিস্টেম হ্যাক করেছিলেন কিনা। তবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে কিছু একটা করে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে মানুষের ভোগান্তি বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ততক্ষণে সংবাদপত্রে ‘এক কিশোরের গ্রামীণ সাইবারনেট হ্যাকিং’ শিরোনামের খবরও ছাপা হয়ে গেল। এর জন্য জাহিদকে মাশুল দিতে হয়েছে কম না। বহুদিন কোর্টে হাজিরাও দিতে হয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য হ্যাকিং ব্যাপারটি তাকে বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল। দেশের আরেকটি বড় আইএসপি ব্র্যাকনেটের ডোমেইন হ্যাক হয়ে গেলে তারা সহায়তা চেয়ে জাহিদের শরণাপন্ন হন।

তার কিছুদিন পর পত্রিকায় আইএসপির (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) একটি বিজ্ঞাপনে জাহিদের চোখ পড়ে। সেখানে সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর চাওয়া হয়। ওয়াক-ইন ইন্টারভিউ। তিনি ইন্টারভিউ দিয়ে পরদিন থেকেই কাজ করতে শুরু করলেন। মাসছয়েকের মধ্যেই তাদের গ্রাহক সংখ্যা দুই হাজারের বেশি ছাড়িয়ে গেল। তখন সারা দেশেই মূলত টেলিফোনের মাধ্যমে ডায়াল-আপ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদান করা হতো। চাকরির এই সময়ে মা-বাবার উৎসাহে এআইইউবিতে অ্যাডমিশনও নিয়ে নিলেন। চাকরি আর পড়া একসঙ্গে চললেও শেষ পর্যন্ত সিজিপিএ চারে চার নিয়ে পাস করেন। এআইইউবির ইতিহাসে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে সেটাই প্রথম পারফেক্ট ৪.০।

তৃতীয় সেমিস্টারে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের ক্লাস পেয়ে যান। ওই সময় থেকেই প্রোগ্রামিংয়ে তার নেশা ধরে  গেল। অনলাইনে প্রোগ্রামিং প্রবলেম সমাধান করা শুরু করলেন। পরের দুই বছরে এক হাজার ২০০ বা এক হাজার ৩০০ প্রবলেম সলভ করলেন। সে সময়  স্পেনের ভ্যালাডলিড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রোগ্রামিংয়ের  সেরা প্ল্যাটফর্ম। তাদের র‌্যাঙ্কিংয়ে জাহিদ সবুর ১৫ নম্বরে উঠে গেলেন। ২০০৪ সালে বুয়েটের সিএসই  ডেতে তার প্রোগ্রামিং টিম চ্যাম্পিয়ন হয়।

২০১৩ সালে গুগল সার্চ টিমে যোগ দেন। তখন সার্চের জন্য কিছু নতুন ফিচার তৈরির সুবাদে প্রমোশনও পেয়ে যান। ফিচারগুলোর একটি ছিল লাইভ টেলিভিশন প্রোগ্রামের ভোটিং হোস্ট করা।  সেটির ভোটিং হোস্ট করার সুযোগ তৈরি হয়ে যায় ওই ফিচারটির বদৌলতে। অনুষ্ঠানের দিন তাকে বাহবা দিতে এসেছিলেন গুগল সার্চের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বলেছিলেন, ‘তুমি একটি স্বপ্নকে সম্ভব করলে।’ গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট উন্মুক্ত হওয়ার পর ২০১৬ সালে আরেকটি প্রমোশন পান।

সর্বশেষ খবর