মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

আমরা একটি স্বপ্ন নিয়েই ক্রিকেট খেলেছি

রকিবুল হাসান

আমরা একটি স্বপ্ন নিয়েই ক্রিকেট খেলেছি

কঠিন সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন যাত্রা করে, তখন থেকেই একটি কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে আজকের এ পর্যায়ে এসেছে ক্রিকেট।

তখন ক্রিকেটের অবস্থা সারা পৃথিবীতে একই রকম ছিল। বর্তমান ক্রিকেট কিন্তু তার নিয়ম পাল্টেছে। ক্রিকেটের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। ক্রিকেটে জৌলুস বেড়েছে। ক্রিকেটের নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে। একই সঙ্গে প্রচুর খেলা হচ্ছে চারদিকে। বিভিন্ন ফরম্যাটে- টেস্ট ম্যাচ, ওয়ানডে, টি-২০ এবং টি-১০ শুরু হবে। ক্রিকেট যে একটি বড় এন্টারটেইনমেন্ট হতে পারে, সেটা কিন্তু আমাদের সে সময়, মানে ১৯৭১ সালে ছিল না। এন্টারটেইনমেন্ট ছিল। টেস্ট ম্যাচের আবহাওয়াটা ছিল পিকনিক পিকনিক ভাব। তখন সবাই পরিবার নিয়ে মাঠে আসত। টেস্ট খেলা দেখত, হইচই করত, খাওয়া-দাওয়া করত। এখন খেলা দেখতে আসে। খাওয়া-দাওয়া কিন্তু মাঠেই করে। এখন পুরো স্টেডিয়ামে ফুডকোর্ট রয়েছে। টেকনিক্যাল বিবেচনায় সে সময়টা অনেক কঠিন ছিল। এটা বলতেই হয়, তখন ক্রিকেট বিশ্ব আমাদের চেয়ে এগিয়েই ছিল।

টেস্ট স্ট্যাটাস, তার আগে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে আমরা স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূূপের মধ্য দিয়ে একটি ‘পণ’ নিয়েই শুরু করেছিলাম। একটি ইচ্ছা নিয়ে শুরু করেছিলাম। আমরা দেশের জন্য খেলব। দেশটাকে এই ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে বিশ্বে পরিচয় করানো যাবে। কারণ ক্রিকেট একটি মানসিক খেলা। একটি টেকনিক্যাল খেলা। দ্য গেম অব স্কিল। আমাদের সামনে সেটার উদাহরণ ছিল। ভারত, পাকিস্তান-এরা সবাই ছিল কিন্তু ক্রিকেটের পরাশক্তি। শ্রীলঙ্কা-টেস্ট স্ট্যাটাস না পেলেও তখন কিন্তু দারুণ শক্তিশালী দল ছিল। সেই ভাবনা আমাদের মধ্যে ছিল। তার ওপর ক্রিকেটের প্রতি আমাদের ভালোবাসাও ছিল। এসব কিছু মিলিয়ে লেখা পড়ার মাঝে ক্রিকেটটাকে ধরে রাখলাম।

ক্রিকেটের জন্য আন্দোলনও করতে হয়েছিল আমাদের। আমি, শেখ কামাল-আমরা সবাই মিলে আন্দোলন করেছিলাম। সে সময় একটি ধোঁয়া তোলা হয়েছিল। অবশ্য স্বাধীনতার পর দুই বছর খেলা হয়নি। ১৯৭৩ সালের পর খেলা হয়। ক্রিকেট নাকি আমলাতান্ত্রিক খেলা, ক্রিকেট নাকি ব্যয়বহুল খেলা। ক্রিকেট সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্রিকেট যায় না। কিন্তু সবাই ভুলে গেল-৯ মাস আগে রকিবুল হাসান নামে একজন বাঙালি পাকিস্তান দলে দলভুক্ত হয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্যাটে ‘জয়বাংলা’ স্টিকার লাগিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) ১২-১৫ হাজার দর্শকের সামনে খেলতে নেমেছিল। ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা সব সময়ই টেস্ট ভেন্যু ছিল। পাকিস্তানে কোনো দল দুটি টেস্ট খেলতে এলে, ঢাকায় একটি খেলা হতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, পার্টিসন অর্থাৎ, ১৯৪৭ সালের পর ভারত-পাকিস্তানের প্রথম টেস্ট ম্যাচটি হয় ঢাকায়। ১৯৫৪-৫৫ সালে এই টেস্ট ম্যাচটির জন্য স্টেডিয়াম বানানো হয়েছিল কাঠের গ্যালারি দিয়ে। এটার পটভূমিতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি। আমরা ক্রিকেট খেলেছি। কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।

স্বাধীনতার পর যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করি, তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, ব্যাট থাকলে বল থাকত না। বল আছে তো প্যাড নেই। সে সময় ২৫ শতাংশ ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছিল খেলার সামগ্রীর ওপর। ধন্যবাদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। উনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন। আমি শেখ কামাল, তান্না রওনা দিলাম। ওনার কাছে খবর চলে গেল। প্রেস ক্লাবের সামনে আমাদের থামিয়ে দেওয়া হলো। সাদা পোশাকের লোকজন শেখ কামালের সঙ্গে কথা বলল। কামাল আমাকে জানাল, কাজ হয়েছে। যাওয়া লাগবে না। আমাদের কাজ হয়ে গেছে। শুনলাম বঙ্গবন্ধু নাকি বলেছেন, কে বলেছে এদেশে ক্রিকেট হবে না? অবশ্যই ক্রিকেট হবে। যে কথা, সেই কাজ। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অধ্যাপক ইউসুফ আলী খান, যিনি শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) সভাপতি বানানো হয়। মোজাফফর হোসেন পল্টু ভাইকে সাধারণ সম্পাদক, একই সঙ্গে আশরাফ আলী চৌধুরী (ধারাভাষ্যকার শামীম আশরাফ চৌধুরীর বাবা)-কে ভাইস প্রেসিডেন্ট, রেজা-ই-করিম, রইস ভাইদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। কঠিন সময়ে ক্রিকেটার ও সংগঠকরা যে কষ্ট করেছেন, আজকের ক্রিকেটাররা তার ফল ভোগ করছেন। এখানে আমাদের আক্ষেপ নেই। আমাদের আনন্দ রয়েছে। আমরা এখনকার ক্রিকেটাররা এখন সেটা ভোগ করছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন বহির্বিশ্বে ব্রান্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটা এখন ‘ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ যখন ভালো করে, তখন সবাই আনন্দ করে। হারলে এক হয়ে কষ্ট পায়। কান্না করে। সাফল্য উদযাপন করতে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক হয়ে যায়। তখন পিছনে তাকিয়ে মনে হয়, ক্রিকেটের জন্য পড়াশোনার সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করে ভুল করিনি।

দেশ ও মাতৃকা আমাদের কাছে অনেক বড়। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। শহীদ হয়েছেন জুয়েল। শহীদ হয়েছেন সংগঠক মুস্তাক। আমরা ভুল করিনি। বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন প্রতিষ্ঠিত। আজকের ক্রিকেটাররা ফল ভোগ করছেন। এখনো কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট দল একটি কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কারণ প্রতিযোগিতার বিশ্বে, আধুনিক বিশ্বে কেউ কাউকে ছাড় দিবে না। প্রতিযোগিতা করতে হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের ক্রিকেটাররা লড়ছেন। হোঁচট খাচ্ছেন। আবার লড়াই করছে। বিশ্বকাপে আমরা কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল, নিদাহাস ট্রফি, এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছি। যুবারা যুব বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মহিলা দল এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমি বলব বাংলাদেশের ক্রিকেট এগোচ্ছে। তবে লড়াই করছে। কঠিন সময়ে মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। এই মুহূর্তে যখন আমি কথা বলছি, রক্তঝরা মাসে কথা বলছি। তখন বলব লড়াই করব। এই লড়াইয়ে জিততেই হবে। এই লড়াইয়ের শেষ নেই। এই লড়াইয়ে আমাদের ক্রিকেটারদের জিততেই হবে। সময় লাগবে। আমাদের ক্রিকেটাররা মাঠে খেলবে। কিন্তু পিছনে খেলতে হবে সংগঠকদের। একটি পরিপক্ব পেশাদারি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতেই হবে।

এখানে আবেগ দেখা যাচ্ছে। আবেগের বশবর্তী হয়ে ক্রিকেটারদের অনেক আবদার রক্ষা করে ক্রিকেট বোর্ড। এটা ভালোবাসা থেকেই করে। মনে হয়, সময় এসে গেছে। এই কঠিন সময়ে আমাদের ক্রিকেটকে আগাতে হলে বিসিবি, কর্মকর্তা ও ক্রিকেটারদের মধ্যে এমন একটি চুক্তি থাকতে হবে, এমন একটি বোঝাপড়া থাকতে হবে, যেখানে মূল মন্ত্র থাকবে ক্রিকেটারদের কাজ মাঠে ভালো খেলা। সংগঠকদের কাজ জোগান দেওয়া। এই ভালো খেলা ও জোগান দেওয়ার মাঝে আবেগের কোনো জায়গা হবে না। ক্রিকেটারদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরে যেতে হবে। সব কিছুর ঊর্ধ্বে দেশের জন্য খেলাটা যে কতটা গর্বে, সেটা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে হবে।

আজকে অনেক কথা হচ্ছে। চুক্তি নিয়ে কথা হচ্ছে। মুস্তাফিজকে নিয়ে কথা হচ্ছে। এমনও কথা হচ্ছে, তারা দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট খেলতে চাইছে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলো পৃথিবীতে এসে গেছে। ভালো খেলোয়াড়রা ঢুকে যাচ্ছে সেখানে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। আমরা বীরের জাতি। আবেগেরও জাতি। আমরা অন্যদের তুলনায় দেশকে বেশি ভালোবাসি। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যারা তাদের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ লোক প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে। সেই বাঙালি, সেই বাংলাদেশ ভালোবেসে কাজ করতে হবে। সেই কাজটি যখন ক্রিকেটার, সংগঠকদের ভিতরে কাজ করবে।

ঘর যখন ঠিক থাকে, যে বাড়িতে বাবা-মা সুন্দর থাকে, যে বাড়ির ঘরের পরিবেশ ভালো থাকে, সে বাড়ির সন্তানরা বড় হবে বুঝে বুঝে। আবার সন্তানদেরও দায়িত্ব, বুঝতে হবে কেন তাদের বড় করা হচ্ছে। ঘরটাকে সুন্দর করার জন্য। এই ঘরটাই এক সময় সমাজ হবে, পাড়া হবে এবং সর্বশেষ রাষ্ট্র হবে। আমি স্বপ্ন দেখি, তবে রাতে নয়। দিনের বেলা স্বপ্ন দেখি। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবুল কালামের কথা। আমি বিশ্বাস করি তার কথা। সেদিন খুব দূরে নয়, আমরাও এগিয়ে যাব। অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও এগিয়ে যাব। এ বিশ্বাস রয়েছে আমার।

 লেখক : ক্রীড়াবিদ।

সর্বশেষ খবর