বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দুই খ্যাতিমান কিংবদন্তি আমজাদ হোসেন ও জসিমের জন্মদিন আজ। দেশীয় চলচ্চিত্রকে তাঁরা নির্মাণ ও অভিনয় দিয়ে সমৃদ্ধ করে গেছেন। বিপুল জনপ্রিয় এ দুই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের জন্মদিনে দর্শক, ভক্ত, অনুরাগীসহ দেশের সংস্কৃতিমনা মানুষ আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে এ দুই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে। জন্মদিনে তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এ আয়োজন তৈরি করেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
চলচ্চিত্রে যাত্রার গল্প...
জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে চলচ্চিত্রজীবন শুরু করেছিলেন জসিম। সারা দিন, সারা রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। সকালে লাইনে দাঁড়িয়ে পারিশ্রমিক পেয়েছেন ১০ টাকা। সেই জায়গা থেকে হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রিয় নায়ক। জসিম, একাধারে তিনি একজন অভিনেতা, চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং মারপিট পরিচালক। বাংলাদেশি অ্যাকশন সিনেমাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে জসিমের অবদান অনস্বীকার্য। জসিম চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন ‘দেবর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে। এ ছবিতে জসিম চলচ্চিত্র পরিচালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও মূল পরিচিতি পান দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের অভিনয় করে। ছবিটি অমিতাভ বচ্চন, আমজাদ খান অভিনীত হিন্দি সিনেমা ‘শোলে’র রিমেক।
বলিউড অভিনেতা আমজাদ খানের প্রশংসা...
১৯৭৭ সালে দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির মাধ্যমে জসিম আলোড়ন তোলেন। বলিউডের ‘শোলে’র রিমেক ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিটিতে জসিম অভিনয় করেন বলিউড অভিনেতা আমজাদ খানের অভিনীত চরিত্রে। এ চরিত্রটি করার জন্য জসিম প্রায় বিশবার ‘শোলে’ ছবিটি দেখেছিলেন। তাঁর অভিনয় দেখে গব্বর সিং চরিত্রে রূপদানকারী আমজাদ খান প্রশংসা করেছিলেন। দোস্ত দুশমন ছবিতে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত জসিম পরে আরও কিছু ছবিতে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। খলনায়ক চরিত্রে অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে - রংবাজ, রাজ দুলারী, দোস্ত দুশমন, তুফান, জবাব, নাগ-নাগিনী, বদলা, বারুদ, সুন্দরী, কসাই, লালু মাস্তান, নবাবজাদা, অভিযান, কালিয়া, বাংলার নায়ক, গরিবের ওস্তাদ, ভাইবোন, মেয়েরাও মানুষ প্রভৃতি।
খলনায়ক পর্বের সমাপ্তি...
জসিমের খলনায়ক চরিত্রে অভিনয়ের সমাপ্তি ঘটে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সবুজ সাথী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এ চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নায়ক হিসেবেই অভিনয় করে গেছেন।
যেভাবে নায়ক...
পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু ‘অমর শরীফ’ সিনেমায় জসিমকে নায়ক হিসেবে বেছে নিলেন। সেই সময় সিনেমা এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। শতাধিক সিনেমায় নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন জসিম।
দেশীয় ছবিতে অ্যাকশনের সূচনা...
বাংলাদেশের ছবিতে মারপিটকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জসিমের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। বলা হয়, ঢাকার ছবিতে জসিমই প্রথম মারপিটের সূচনা করেন। চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন বলেন, ‘জসিম যখন ফিল্মে যোগ দেন তখন থেকেই ঢাকায় হিন্দি ছবির কাহিনি চুরি করে ছবি নির্মাণের হিড়িক পড়ে গেল। জসিমকেও ওই সময় বেশ কিছু নকল ছবিতে অভিনয় করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও প্রতিভাগুণে জসিম একটা ভিন্ন স্টাইল সৃষ্টি করেছিলেন।’ জসিম-আরমান-মাহবুব এ তিনজন মিলে তৈরি করেছিলেন জেমস ফাইটিং গ্রুপ। যারা চলচ্চিত্রের মারপিট পরিচালনা করতেন এবং স্ট্যান্ট সরবরাহ করতেন। জসিম বলেছিলেন, অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল শুরু থেকেই। অভিনয় না করলেও পর্দার বাইরে আজীবন ফাইট ডিরেক্টর হিসেবে থাকতে চেয়েছিলেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ফাইট ডিরেক্টর হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। তিনি ন্যাশনাল কোচিং সেন্টার থেকে মার্শাল-জুডো শিখেছেন। সিনেমার ফাইট ডিরেক্টর হিসেবে জসিম নিজেকে মেলে ধরেছিলেন মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে। পশ্চিমা সিনেমা থেকে ধারণা নিয়ে ফাইট প্রয়োগ করতেন তিনি। নায়কের সঙ্গে ফাইট করার সময় দর্শকরা ভিলেন জসিমের জন্য হাততালি দিতেন।
শাবানার প্রেমিক ও ভাইয়ের চরিত্রে সফল...
জসিমই দেশে একমাত্র নায়ক, যিনি কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানার সঙ্গে প্রেমিক এবং ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। দুটি চরিত্রই দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ‘সারেন্ডার’ ছবিতে শাবানার প্রেমিক হিসেবে সফল হয়েছেন জসিম। সেই শাবানাই ‘সবুজ সাথী’, ‘অবদান’ ও ‘মাস্তান রাজা’ ছবিতে জসিমের বড় বোন হিসেবে সফল হয়েছিলেন।
রিয়াজকে চলচ্চিত্রে আনেন...
জসিমই আবিষ্কার করেছিলেন জনপ্রিয় নায়ক রিয়াজকে। ১৯৯৪ সালে রিয়াজ চাচাতো বোন ববিতার সঙ্গে বিএফডিসিতে ঘুরতে গিয়ে জসিমের নজরে পড়েন। জসিম তখন তাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। ১৯৯৫ সালে জসিমের সঙ্গে ‘বাংলার নায়ক’ নামের একটি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন রিয়াজ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা...
অভিনেতা জসিম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সৈনিক হিসেবে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছেন তিনি।
ব্যক্তিজীবন...
জসিমের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকার নবাবগঞ্জে। চলচ্চিত্রে শুধু জসিম হিসেবে পরিচিত হলেও এ নায়কের আসল নাম আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন। জসিমের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ পর্যন্ত। তিনি অভিনেত্রী সুচরিতাকে বিয়ে করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে নাসরিনকে বিয়ে করেন। জসিমের তিন ছেলে। রাতুল, রাহুল, সামি। যার মধ্যে রাতুল ও সামি ব্যান্ডের বেজিস্ট ও ড্রামার। রাহুল ব্যান্ডের গিটারিস্ট। ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে এফডিসির ২ নম্বর ফ্লোরের নামকরণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা জসিম ফ্লোর।
আমজাদ হোসেনকে নিয়ে ববিতা
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের জন্মদিন আজ। ১৯৪২ সালে জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জীবদ্দশায় বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন তিনি। অভিনয়ও করেছেন চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকে। পরিচালনার মতো অভিনয়েও দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা। আজ তাঁর জন্মদিনে আমজাদ হোসেনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন এ খ্যাতিমান অভিনেত্রী। তিনি বলেন, ‘আমজাদ হোসেন মাটি ও মানুষের কথা বলতেন তাঁর ছবিতে। জীবনের ছায়া তাঁর চলচ্চিত্রে উঠে আসত সুনিপুণভাবে। আমার চোখে চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে একজন আমজাদ হোসেনই সেরা।’ আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমনি’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘বড় বাড়ির মেয়ে’ ছবির নায়িকা ববিতা আরও বলেন, ‘আমজাদ হোসেন বাংলাদেশে একজনই, ব্যক্তি ও সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অতুলনীয়।’ আজ তাঁর জন্মদিনে এ খ্যাতিমান নির্মাতাকে দুঃখভরে স্মরণ করতে গিয়ে একটি ঘটনার অবতারণা করে তিনি বললেন, ‘১৯৭৮ সাল, মানিকগঞ্জের এক গ্রামে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবির শুটিং চলছে। সারা দিন অপেক্ষায় আমি। অন্য শিল্পীরা শুটিংয়ে অংশগ্রহণ করলেও আমার ডাক আসে না। যখন ডাক আসে, তখন রাত ২টা। কনকনে শীতের মধ্যে ওই রাতে আনন্দচিত্তেই সংলাপ দিতে দাঁড়ালাম আমি। কারণ, ছবির পরিচালক আমজাদ হোসেন।’ বরেণ্য এ পরিচালক মারা গেছেন আজকের এ দিনে, ২০১৮ সালে। ববিতা বলেন, তাঁর অনেক ছবি মাইলস্টোন হয়ে আছে। আমজাদ হোসেনের ছবিতে কাজ করে শিল্পীরা বেশ তৃপ্তি পেতেন। এমনও হতো, একটি দৃশ্যের শুটিং হবে সকালে, সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে আছি। আমরা মোটেও বিরক্ত হতাম না। শুটিংয়ের আগে খুব একটা স্ক্রিপ্ট দিতেন না। ধারণা দিয়ে রাখতেন। কখনো শুটিং স্পটেও সংলাপ বদলে যেত। ববিতা বলেন, ‘শুটিং স্পটে বসেও সংলাপ লিখতেন। আমরা চা খাচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি, তাকিয়ে দেখছি মনোযোগ দিয়ে আমজাদ ভাই লিখছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে তিনি দিয়েছেন দুই হাত খুলে।’