শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে দিন বদলের ছোঁয়া

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

স্বাধীনতার পর চার দশক আগেও বাংলাদেশের গ্রাম মানেই ছিল জরাজীর্ণ ঘর-দুয়ার আর দারিদ্র্যের আঘাতে জর্জরিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। ১০০ জন মানুষের মধ্যে ৮০ জনই ছিল দরিদ্রশ্রেণির। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। হার-জিরজিরে হাড্ডিসার শরীরগুলো কাজের অভাবে না খেয়ে দিন কাটাত। বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ছিল মঙ্গা, ছিল অভাব-অনটন। সেই ছবিটা বদলে গেছে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে লেগেছে দিন বদলের ছোঁয়া। এখন গ্রামে আর কুঁড়েঘর খুঁজে পাওয়া যায় না। আছে টিনের ঘর, পাকা বাড়ি। হাড্ডিসার মুখগুলোও নেই। এর বদলে কর্মজীবী মানুষ আছে, পকেটে টাকাও আছে। ঘরে আছে রঙিন টেলিভিশন, ফ্রিজ। কারও আবার কম্পিউটার, তাতে জুড়ে দেওয়া ইন্টারনেট। ঘরে বসে এখন বাংলাদেশের কোনো এক প্রান্তের মানুষ হাতের মোবাইল টিপে মুহূর্তেই যোগাযোগ করছে প্রবাসের প্রিয়জনের সঙ্গে।

পেছনে চোখ ফেরানো যাক। স্বাধীনতার পর কেমন ছিল সদ্য জন্ম নেওয়া এই বদ্বীপ অঞ্চলের দিনগুলো? ১৯৭৩-৭৪ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে খানা জরিপ করেছিল, সেই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, তখন একটি খানার (পরিবারের) মাসিক গড় আয় ছিল ৪৬৪ টাকা। গ্রামের একজন মানুষ দিনে গড়ে মাত্র ২৬ গ্রাম মাছ খেত, ৪ দশমিক ৯৩ গ্রাম মাংস খেতে পারত, ডিম খেতে পারত ১ দশমিক ১৬ গ্রাম। পরিবারগুলো খাদ্যের পেছনে ব্যয় করত তাদের মোট ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ।

তখনকার সময়ে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ শতাংশের কাছাকাছি। শতকরা ৮০ ভাগের বেশি মানুষ ছিল দরিদ্রশ্রেণির। মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর। বেশির ভাগ বাড়িতে ছিল কুঁড়েঘর ও মাটির দালান। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ছিল না বললেই চলে। নিরাপদ পানি ব্যবহারের হারও ছিল নগণ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিবর্তনের ছবিটি মিলিয়ে দেখা যাক। বর্তমানে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭০ বছর। জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত এক দশক থেকেই ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে সাম্প্রতিক বছরে ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সর্বশেষ খানা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে খানা বা পরিবারপ্রতি মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২৪ শতাংশে। একজন মানুষের দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার গ্রাম। ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রায় অর্ধেক বাড়িঘর টিন ও কাঠের তৈরি। উপরন্তু প্রায় ৩০ শতাংশ রয়েছে পাকা বাড়ি। প্রায় ৯৫ শতাংশ পরিবার নিরাপদ পানি পান করছে। বেড়েছে বিদ্যুৎ ব্যবহারের হারও। ২০১০ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৫৭ দশমিক ৯ ভাগ; ২০১৬ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ৬৫ দশমিক ৬ ভাগ। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে উপকারভোগী ২০১০ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৬ ভাগ; ২০১৬ সালে তা ২৮ দশমিক ৭ ভাগে উন্নীত হয়েছে। ২০১০ সালে ৩২ শতাংশ মানুষ ছিল ঋণগ্রস্ত; ২০১৬ সালে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশে। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে এমন পরিবার ছিল ৫৫ দশমিক ২৬ ভাগ। ২০১৬ সালে বিদ্যুতের এ হার ৭৫ দশমিক ৯২ ভাগে উন্নীত হয়েছে। যেসব এলাকায় বৈদ্যুতিক সংযোগ যায়নি, সেখানকার মানুষও পিছিয়ে নেই বৈদ্যুতিক সুবিধা থেকে। সৌরবিদ্যুতের সুবিধা নিয়ে তারাও এখন টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার চালাচ্ছে।

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে এই পরিবর্তনটা এক দিনে হয়নি। দিনে দিনে একটু একটু করে বদলে গেছে বাংলাদেশ। শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনেও লেগেছে প্রযুক্তি ছোঁয়া। মেঠোপথের বদলে পাকা সড়ক হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গেও সরাসরি রচিত হয়েছে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। পিছিয়ে পড়া উত্তরবঙ্গ কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে সামনে চলে এসেছে বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর। এবার দক্ষিণ বঙ্গকেও যুক্ত করা হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত সেবার উন্নয়নে পরিবর্তন এসেছে কৃষিতেও। বর্গাচাষিদের জন্য বিনা জামানতে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন কৃষকরা। প্রায় এক কোটি কৃষকের আছে নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে সত্তরের দশকে যেখানে গরু, হাল আর কাস্তে ছিল কৃষি উৎপাদনের অন্যতম হাতিয়ার, এখন সেখানে যান্ত্রিক কলের মাধ্যমে সেচ থেকে শুরু করে নিড়ানি, ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে। ফসল উৎপাদনেও কৃষকরা এখন ব্যবহার করছেন প্রযুক্তি। কোন ফসলে কী পরিমাণ সেচ দিতে হবে, কতটা সার লাগবে, পোকা-মাকড় দমনে কী ধরনের ওষুধ ব্যবহার করতে হবে সবই জানা যাচ্ছে মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে। উৎপাদিত পণ্যের দামও জানা যাচ্ছে সহজে। জানা যাচ্ছে পণ্যের চাহিদা সম্পর্কেও।

কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামের সাধারণ কৃষকের আয় বেড়েছে। অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কৃষক জড়িত হওয়ায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। শাক-সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) তথ্য অনুসারে, আম উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া পেয়ারা উৎপাদনে অবস্থান অষ্টম। আর মোট ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন শুধু খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ তা-ই নয়, তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। কৃষির পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বাড়ছে। পুরুষের পাশাপাশি এসব শিল্পে গ্রামের নারীরাও শ্রম দিচ্ছে। বাঁশ, কাঠ ও বেতের তৈরি হস্তশিল্প, নকশি কাঁথা, পোশাকে অ্যাম্ব্রয়ডারি, টুপি বানানো, কাপড়ের পুতুলসহ ছোটদের খেলনাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন গ্রামের নারীশ্রেণি। এসব পণ্য আবার বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। শুধু কি তাই? বিদেশি কৃষিপণ্য উৎপাদন করেও এখন রপ্তানি করছে বাংলার কৃষক। ২০১৬ সালে ৬ লাখ ৩৪ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রায় এক লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। একই সময়ে ৪১ হাজার ৬৭৫টি এসএমই নারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

শিল্প ও সেবার ক্ষেত্রেও ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তৈরি পোশাক শিল্পে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এখন একটি ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। চীন-জাপান ও ইউরোপ-আমেরিকার পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন বাংলাদেশের এই খাতে বিনিয়োগের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ওষুধ, চামড়া এবং আইটি শিল্পেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকার এসব শিল্পকে অন্যতম রপ্তানি খাত হিসেবে নীতিনির্ধারণী সহায়তা দিচ্ছে। দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি হচ্ছে। আর ১২৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ। গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে গেছে ই-কমার্সের সুবিধা। সারা দেশে নেটওয়ার্ক বিস্তার হওয়ায় মোবাইল সিমকার্ড ব্যবহারের সংখ্যা ১৩ কোটি ছাড়িয়েছে। আর ৬ কোটি ছাড়িয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ‘ইনফো-সরকা ২’ প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৮ হাজার ১৩০টি সরকারি দফতরে কানেক্টিভিটি স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮০০ অফিসে ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন, ২ হাজার ৬০০টি ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্যাল কানেক্টিভিটি, প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলের ৭৭২টি ইউনিয়ন এবং সারা দেশে ৮ হাজার ৫০০টি শাখা ডাকঘরকে ইন্টারনেট সংযুক্তির আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে গ্রামে বসে শিক্ষিত যুবকরা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুহূর্তেই টাকা লেনদেন করতে পারছে শহর ও গ্রামের মানুষ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখন ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বড় গ্রাহক।

ঘরে বসে স্বাস্থ্যসেবা পেতে সরকার চালু করেছে স্বাস্থ্য বাতায়ন। ১৬২৬৩ নম্বরে ডায়াল করে পাওয়া যাচ্ছে চিকিৎসা সম্পর্কিত সব তথ্য। ২৪ ঘণ্টাই পাওয়া যাচ্ছে চিকিৎসকের পরামর্শ। এ ছাড়া ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিলেই মিলছে জরুরি সেবা। দুর্ঘটনায় যে কোনো সেবা কিংবা পুলিশি সহায়তা সবই এখন হাতের নাগালে। সত্তরের দশকে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ ছিল অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আর বর্তমানে দেশে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা (ডিপেনডেন্সি রেশিও) শতকরা ৫৪ ভাগে নেমে এসেছে। দেশে কর্মশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০ ভাগ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসা হয়েছে। ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবার শীর্ষে। নারী-পুরুষ সমতার দিক দিয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। জেন্ডার ইকুয়িটির ক্ষেত্রে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এরই মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। এভাবেই ধীরে ধীরে বদলে গেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটি। আর উন্নয়নের ধারায় সবচেয়ে বড় সুখবর যেটি, সেটি হচ্ছে, স্বাধীনতার পরপর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা পাওয়া বাংলাদেশ এই মাসেই পেতে যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা, যা বাংলাদেশকে ভারত, পাকিস্তান, চীনের কাতারে নিয়ে যাবে। এরপর দৃষ্টি উন্নত দেশের দিকে। পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘৯ বছর আগে বিশ্ব অর্থনীতিতে আমাদের অবস্থান ছিল ৫৮তম। মাত্র ৯ বছরে আমরা সেখান থেকে ৪৩তম স্থানে এসেছি। ৯ বছরে ১৫টি সিঁড়ি ভেঙে আমরা এ অবস্থানে এসেছি। যদি ৯ বছরে আমরা ১৫টি সিঁড়ি ভাঙতে পারি, তবে ২০৪১-এ পৌঁছানোর জন্য আমাদের হাতে আছে এখনো ২৩ বছর। এই ২৩ বছরে আমাদের প্রয়োজন আর ২৩টি সিঁড়ি ভাঙা। এই ২৩টি সিঁড়ি ভাঙলেই আমরা ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের একটি উন্নত দেশ হব, যার স্বপ্ন দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’

সর্বশেষ খবর