বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন ও হয়রানির প্রতিবাদ এবং তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানাতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছেন চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। শহীদ মিনারে আয়োজিত বিশাল জমায়েতে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেন। ছিলেন কবি ও লেখকসমাজও। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত
হয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন তাঁরা। এ ছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে সাংস্কৃতিক সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। বৃষ্টিতে ভিজে গান, কবিতা আর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ সমাবেশের আয়োজন করে সংগঠনটি। কোটা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সংঘাতে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। প্রাণহানির ঘটনার প্রতীক হিসেবে সমাবেশের সামনে রাখা ছিল কফিন। শহীদ মিনারে বক্তব্য দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা বলেন, দেশে যে বৈষম্য ও অরাজকতা চলছে এটি রুখতে ছাত্রসমাজ আজ মাঠে নেমেছে। দেশের সব চিকিৎসক শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে পাশে আছে এবং সর্বক্ষণ তাদের পাশে থাকবে। অন্য একজন চিকিৎসক বলেন, হত্যার প্রতিবাদে যখন আমরা কর্মসূচি দিলাম তখন দেখলাম থানায় সব মাইক নিয়ে গেছে। চিকিৎসক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এর প্রতিবাদে অন্যান্য শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এলে তাদের ওপরও একই কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। অনেক আহতকে চিকিৎসা দিতে বা হাসপাতালে নিয়ে যেতেও দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তাঁরা। সমাবেশ শেষে শহীদ মিনার থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত মিছিল করেন চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীরা।
উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, কোটা আন্দোলনের মতো একটি আন্দোলন সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যর্থতার দায়ে বীভৎস অবস্থায় চলে গেছে। যা কিছু ঘটেছে এর দায় সরকারের ওপর বর্তায়। সংগঠনের সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম বলেন, ছাত্রহত্যার দায় সরকারকে নিতে হবে। আমরা জাতিসংঘের অধীনে তদন্ত ও বিচার দেখতে চাই। সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, সরকার এক একটি দুর্নীতির ঘটনা, আন্দোলন ধামাচাপা দিতে আরেকটি ঘটনা সামনে নিয়ে আসছে। দেশে শিক্ষকদের আন্দোলন চলছিল, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, চা-শ্রমিক, পোশাকশ্রমিক সব খাতে কিছু না কিছু আন্দোলন চলছিল। এসব থেকে সব নজর ঘুরে যায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায়। সমাবেশে অংশ নেওয়া চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও খেলাঘরের প্রতিনিধিরা বলেন, এ আন্দোলনে যুবসমাজের ক্ষত সারতে বহুদিন লাগবে।
দ্রোহযাত্রা : কোটা আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতার পর গ্রেপ্তার সবার মুক্তির দাবিতে দ্রোহযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে অংশ নেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, রোবায়েত ফেরদৌস, সি আর আবরার, উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা, চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমেদ সায়মন, সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকলি মজুমদার, আইনজীবী মানজুর মতিনসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মী।
এ সময় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আমরা ’৫২-এর পর থেকে অনেক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, কিন্তু এই জুলাইয়ে মাত্র কয়েক দিনে যে রকম হত্যাযজ্ঞ হয়েছে এ রকম হত্যাযজ্ঞ আর কোনো সরকার করেনি, এত রক্তপাত কেউ করেনি। সরকার ভেবেছিল এ রকম নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালালে আন্দোলন দমে যাবে। কিন্তু প্রতিবাদ আরও বেড়েছে। তিন বছরের বাচ্চা থেকে শ্রমজীবী পেশাজীবী সবার ওপর আক্রমণ আসছে। জমিন থেকে আক্রমণ আসছে, আকাশ থেকেও আক্রমণ আসছে। গুলিতে ৩ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। যারা নিহত হয়েছে তাদের মা-বাবারা হাহাকার করছেন। হাজার হাজার আহত হয়েছেন, তাদের মা-বাবারা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তিনি বলেন, এ সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াপাওয়ার কিছু নেই। এ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।
সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে ‘দ্রোহযাত্রা’ নামের এ বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও ব্যানার নিয়ে শহীদ মিনারে যান। ‘কী দরকার ছিল এই অন্ধের শহরে চশমা বিক্রি করার?’, ‘লাশের হিসাব করি নাই রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘কত বুলেট আছে গুলি কর, আমরা অনেক দিন হাসি না’ ইত্যাদি পোস্টার ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে খন্ড খন্ড মিছিল থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এ মিছিলে অংশ নেন অভিভাবকরাও।