বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সহসম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তির কথা আগামী দিনে কেউ চিন্তা করলেও ছাত্র-জনতা তাদের রুখে দেবে। তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে দেশের বাইরে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি শিগগিরই তিনি বীরের বেশে দেশে ফিরবেন। দেশবাসী তার অপেক্ষায় রয়েছেন।
গতকাল ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের নিজ বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। এ সময় রুমিন তার দল বিএনপি, আগামীর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন।
গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামল প্রসঙ্গে রুমিন ফারহানা বলেন, ১৫ বছরে দেশের সর্বনাশ বলতে যা বোঝায় আওয়ামী লীগ সবই করেছে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যা তারা দলীয়করণ করেনি। গণমাধ্যম, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগসহ প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করেছে। লোভে, প্রলোভন অথবা ভয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দলীয় ক্যাডারের মতো ব্যবহার করেছে। সালমান, এস আলমসহ ব্যবসায়িক ক্যাডার তৈরি করেছে। ফারজানা রূপার মতো অনেককে সাংবাদিক ক্যাডার বানিয়েছে। বেনজীর, হারুন, আছাদুজ্জামান মিয়া, বিপ্লবের মতো পুলিশ প্রশাসনে অনেক দানব সৃষ্টি করেছে। তাদের অনেক বেশি অবৈধ সুবিধা দিয়েছে। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা সরকারের এবং সরকারি দলের দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করেছে। শুধু ক্ষমতায় থাকার লালসায় আওয়ামী লীগ জাতিকে, রাষ্ট্রকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। উত্তরণের পথ কী জানতে চাইলে রুমিন ফারহানা বলেন, আমরা যাত্রা শুরু করেছি। ১৫ থেকে ২০ দিনে সাড়ে পাঁচ শ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা নানাভাবে আহত হয়েছে। অনেকেরই দুই চোখে গুলি লেগেছে। অসংখ্য মানুষ বছরের পর বছর কারাগারে ছিলেন। সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আজকে দেশবাসী বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। কারাগারে বন্দি করা হয় গণতন্ত্রকামী হাজার হাজার জনতাকে। প্রতিবাদীকে দমন করতে আয়নাঘরের মতো নিষ্ঠুরতম স্থানে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। এরপরও যদি আমাদের চৈতন্য ফিরে না আসে, রাজনীতিকে ঢেলে সাজাতে না পারি, নতুন মানুষদের রাজনীতিতে এনে রাজনীতিকে সমৃদ্ধ সৎ নির্লোভ, দেশের প্রতি যার কমিটমেন্ট আছে তেমন মানুষের হাতে রাজনীতিকে না দিতে পারে তবে পরিণতি শেখ হাসিনার মতোই আমাদের হবে। কয়েক বছর পর পর প্রত্যেককেই তা ভোগ করতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে আপনি কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বিএনপির সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, অনেকে বলবেন দেড়-দুই মাসের কোটা সংস্কারের আন্দোলন। কিংবা শুধু তরুণদের বিস্ফোরণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ শাসনামলের দুঃশাসন, ক্ষোভ, বঞ্চনা, কষ্ট ভয়, কথা বলতে না পারা যন্ত্রণা সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ। এতে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন তরুণরা। তিনি বলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং গর্ব করে বলেন, আমার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। আমাদের সাধারণ মানুষের ১০০ টাকা কেজি ধরে চাল কিনে খেতে গিয়ে খাবার কমিয়ে দিতে হয়। আর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার বসে জনগণকে সব সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। বেগুনের পরিবর্তনে মিষ্টিকুমড়া, তেল ছাড়া রান্না, মাংসের বিকল্প হিসেবে কাঁঠালের তরকারি খাওয়ার কথা বলেছেন। জনগণের সঙ্গে রীতিমতো ফাজলামো করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিএনপির প্রত্যাশা কী জানতে চাইলে বিএনপির এই নেত্রী বলেন, দেশে সুশাসন ফিরিয়ে আনা। আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা। রাজনীতির প্রতি জনগণের যে অনীহা ছিল তা ফিরিয়ে আনা। যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের কারণে ভেঙে পড়েছিল তাতে স্বচ্ছতা আনা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যাতে মানুষ নির্ভয়ে তাদের ভোট প্রয়োগ করতে পারে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের জন্য সময় বেঁধে দিতে চাই না। আমরা আশা করব, যত দ্রুত সম্ভব একটা গ্রহণযোগ্য সময়ের মধ্যে ভোটের আয়োজন করবে বর্তমান সরকার। যেখানে সব দলমতের মানুষ ভয় ছাড়া, কোনোরকম চাপ ছাড়া পছন্দের মানুষকে ভোট দিয়ে কার্যত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের কোনো মানুষকে দেশে না ফেরার মতো অসংবিধান বিষয় হতে পারে না। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে তাকে দেশের বাইরে রাখা হয়েছে। তার বক্তব্য পর্যন্ত প্রচার করতে দেওয়া হয়নি। আইন করে তার বাকস্বাধীনতাও রুদ্ধ করা হয়েছিল। বারবার আদালতকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে রায় দেওয়া হয়েছে। এমনকি আইনের দোহাই দিয়ে তার বক্তব্য পর্যন্ত কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। তাকে অধিকারবঞ্চিত করা হয়েছে। এটা স্বৈরাচারী সরকারের বহিঃপ্রকাশ। আলহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশ সঠিক পথে ফিরতে শুরু করেছে। আমরা আইনি কাজগুলো করছি। আশা করছি তিনি শিগগিরই দেশে ফিরবেন। তিনি বীরের মতো দেশে ফিরবেন। দেশবাসী তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের অপেক্ষায় রয়েছেন।
বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক-বিষয়ক কমিটির এ সদস্য বলেন, বিএনপি যথেষ্ট গোছানো আছে। নানাভাবে আমাদের নেতা-কর্মীদের ভয়-লোভ দেখানো হয়েছে। কেউ দল ছেড়ে যায়নি। আদর্শিক দল হিসেবে বিএনপি শক্তিশালী অবস্থানে আছে। অনেক হুমকি সত্ত্বেও কেউ দল ছেড়ে যায়নি। বিএনপিসহ আমাদের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর গ্রাম পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। যে কোনো সময় নির্বাচন হলে আমরা আশাবাদী জনগণের ভোটে আমরা ক্ষমতায় আসব, ইনশাআল্লাহ। বিভিন্ন সময়ে বিএনপির সঙ্গে রাজপথে ভূমিকা রাখা দলগুলো প্রসঙ্গে রুমিন ফারহানা বলেন, শেখ হাসিনার দুঃশাসনে সবাই এক ছাতার নিচে এসেছি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারাই ভূমিকা রেখেছে সবাইকেই দল সম্মানিত করবে আশা করি। যারা দুঃসময়ের বন্ধু তারা সুসময়েরও বন্ধু। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে বলেন, গত ১৭ বছরে রাজনৈতিকভাবে যে মানুষটির ওপর সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন চালানো হয়েছে তিনি হলেন বেগম খালেদা জিয়া। এই নিপীড়নের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ওনাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। যে মানুষটি ২০১৮ সালে হেঁটে গাড়িতে উঠে কারাগারে গেছেন এখন দাঁড়াতে পর্যন্ত কষ্ট হয়। তিনি গত কয়েক বছর সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাকে কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে তার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেন, বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, তবে প্রভু নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কাউকে প্রভু মনে করি না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশের মানুষকে একটি সময় বা পর্যায় পর্যন্ত আটকিয়ে রাখা যায়, তারপর রুখে দাঁড়ায়। আগামী প্রজন্মও সব দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলে নতুন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করে আমরা স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তুলব। মেধার ভিত্তিতে আগামীতে গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ।