বিশেষ অভিযানেও হদিস মিলছে না লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের। বিভিন্ন সংস্থার লুট হওয়া এসব অস্ত্রসহ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে ব্যবহার হওয়া অবৈধ অস্ত্রে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। অভিযোগ উঠেছে, এসব অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে সন্ত্রাসীদের কাছে। গত বৃহস্পতিবার রাতেও চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে দুজনকে হত্যার ঘটনা ঘটে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ অভিযান শুরুই হয়েছে মূলত অবৈধ এবং লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের জন্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশের বিভিন্ন থানা থেকে ৫ হাজার ৮১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৩৩টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ১ হাজার ৮১৮টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। গত ৫ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রতিবেদনে পরিসংখ্যানের এ তথ্য দেওয়া হয়।
কারা সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে অস্ত্রাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র লুট করা হয়। এর
মধ্যে ৫৩টি উদ্ধার হয়েছে। শেরপুর কারাগার থেকে আটটি অস্ত্র খোয়া যায়। এর মধ্যে সাতটি উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। এখনো একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
অপরাধ বিশ্লেষজ্ঞরা বলছেন, লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বেহাত হওয়া অস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ব্যবহৃত হলে জনজীবনের নিরাপত্তায় তা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আর তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আরও কঠিন হবে। গত ৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ৮টার দিকে মোহাম্মদপুর থানাধীন বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে তিনটি শর্টগান, ৯৮ রাউন্ড কার্তুজ ও ১টি পুলিশ বেল্ট থেকে উদ্ধার করেছে র্যাব-২ এর একটি দল। র্যাব জানায়, উদ্ধার করা ওই অস্ত্র ও গোলাবারুদ গত ৫ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে লুট করা হয়েছিল। এর বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় এজহারনামীয় পলাতক আসামি সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ছেলে শিরহান শরীফ তমালকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ৪ রাউন্ড গুলি, ১০ পিস ইয়াবা ও ১টি প্রাইভেট কারসহ পাবনার ঈশ্বরদী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১২। এর মধ্যে গত ২৯ আগস্ট দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় মো. আনিস (৩৮) ও মাসুদ কায়সার (৩২) নামের দুজনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আনিস ও কায়সার অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়ক ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। নাহার কমিউনিটি সেন্টার এলাকায় পৌঁছালে মোটরসাইকেলে আসা দুই দুর্বৃত্ত তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। স্থানীয়রা গুলিবিদ্ধ দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানীর মিরপুর টেকনিক্যাল মোড়ে মাংস ব্যবসায়ী রইস বেপারীকে গুলি করে ৩ লাখ টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। গত ২৯ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলের বঙ্গভবন মোড়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মো. ইমরান নামের এক ব্যক্তি। হঠাৎ একটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমে আসে দুই অজ্ঞাত ব্যক্তি। তার মাথার দুই দিকে দুটি পিস্তল ঠেকায়। ছিনিয়ে নেয় তার সঙ্গে থাকা ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা ও মোবাইল ফোন। ওই ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভুক্তভোগী। এ তো গেল মাত্র তিনটি ঘটনা। এমন ঘটনা দেশের বিভিন্ন এলাকায় হরহামেশাই ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ এখনো পুরোদমে সক্রিয় না হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। কারণ, বেশির ভাগ লুট হওয়া অস্ত্র এবং গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি। এর বাইরে সন্ত্রাসীদের হাতে আরও অনেক অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। যা দিয়ে দেশে হত্যা, লুট, অপহরণসহ নানান অরাজকতা চলছে। এই পরিস্থিতিতে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে সারা দেশে যৌথ অভিযান পরিচালনা করার ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মূলত বিভিন্ন সংস্থার লুট হওয়া অস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধারের দিকে আমাদের বিশেষ নজর রয়েছে। তবে সমাজের শান্তিশৃঙ্খলার জন্য হুমকি চিহ্নিত অপরাধী, ছাত্র আন্দোলনে গুলি-হামলার নির্দেশদাতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে লুণ্ঠিত ও উদ্ধারকৃত অস্ত্র গোলাবারুদের পরিসংখ্যান হালনাগাদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে চায়না রাইফেলের সংখ্যা ১ হাজার ১৪৫টি। ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৩৮টি এসব রাইফেল উদ্ধার হয়। ২৯৭টি উদ্ধার হয়নি। এসব রাইফেলের এসএমজি ২৫১টি, এলএমজি ৩২ লুট হয়। এর মধ্যে ১৮৫টি এসএমজি ও ২১টি এলএমজি উদ্ধার হয়। তবে ৬৬টি এসএমজি ও ১১টি এলএমজি উদ্ধার হয়নি। এর বাইরে ১ হাজার ৫৯২টি পিস্তল লুট হয়। তার মধ্যে ৭৩২টি উদ্ধার হলেও ৮৬০টি পিস্তল উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া ২ হাজার ১৯১টি বোর শটগান লুট হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৬২৪টি উদ্ধার হলেও ৫৬৭টি শটগান উদ্ধার হয়নি। সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুলিশ থানার ভিতরে সক্রিয় থাকলেও মাঠে এখনো তেমন টহলে নেই। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ঢাকাসহ সারা দেশেই হত্যাকান্ড ছিনতাই ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ বাড়ছে।
শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও অস্ত্রবাজরা অধরা : গত ২ আগস্ট লক্ষ্মীপুর শহরে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। এই মিছিলে গুলি চালানো হয়। কিন্তু এ সময় ব্যবহার করা অস্ত্রটি এখনো জব্দ হয়নি। সরকারের আহ্বানের পরও এটি জমাও পড়েনি। এর বাইরে সারা দেশে বিভিন্ন হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বৈধ-অবৈধ কোনো অস্ত্র এখন পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চিহ্নিত অস্ত্রধারীদেরও আনা হয়নি আইনের আওতায়।
বাংলাদেশ আর্মস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাসির আহমেদ জানান, ২০১৬ সালে বিধিনিষেধ জারির পর অস্ত্র বিক্রি একেবারেই কমে গেছে।
বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত : ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিগত ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য দেওয়া সব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স (কর্মরত সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তা ছাড়া) স্থগিত করা হলো। তাদের আগামী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। ‘দ্য আর্মস অ্যাক্ট, ১৮৭৮’ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা ‘আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা, ২০১৬’ অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলেও প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।