অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মূল্য শুল্কায়নে একই নীতি বাস্তবায়নসহ বেশ কিছু বিষয়ে এ খাতের নীতিনির্ধারক এবং উদ্যোক্তাদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এ খাতে এখন সরকারি ও বেসরকারির মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতি থাকার কারণে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকরা বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারের কাছে এ খাতের উদ্যোক্তারা বাড়তি কোনো সুবিধা না চাইলেও অন্তত জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়ন বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। এরই মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকদের একটি প্রতিনিধি দল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে সচিবালয়ে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে তারা অপরিশোধিত তেল আমদানিতে দ্বৈতনীতির পরিবর্তে একই শুল্কনীতি বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করেন। এ খাতের উদ্যোক্তারা জ্বালানি উপদেষ্টাকে জানান, দ্বৈতনীতির কারণে তারা নানাভাবে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ খাতে বিনিয়োগেও আগ্রহ হারাচ্ছেন। জ্বালানি উপদেষ্টা বিষয়টি পর্যালোচনা করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হবে বলে প্রতিনিধি দলকে জানান। এ বিষয়ে উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা কমিটি গঠন করার বিষয়টি জানতে পেরেছি। এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে এক্ষেত্রে যদি নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠন করা হয় তবে এ খাতের জন্য তা ইতিবাচক হবে বলে তারা জানিয়েছেন।
দেশের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি ও পরিশোধন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-এর কাছে সরবরাহ করছে। বেসরকারি পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারটেক্স গ্রুপ একটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর কুমার ঘোষ বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারির মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতি থাকার কারণে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকরা দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একদিকে অপরিশোধিত তেল আমদানির সময় ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করার কারণে আমাদের ডিউটি বেশি দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আমরা যখন রিফাইন করে বিপিসির কাছে পরিশোধিত তেল বিক্রি করি তখন বিপিসি আমাদের ট্যারিফ ভ্যালুতে প্রাইসিং করে টাকা ফেরত দেয়। এতে আমরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ মূল্য শুল্কায়নে দুই নীতির কারণে পুরো সক্ষমতায় আমরা উৎপাদনে যেতে সাহস করতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘আমার রিফাইনারিতে দৈনিক ১২ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেশি। বাড়তি ডিউটির কারণে বাড়তি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বেসরকারি রিফাইনারিগুলোতে যত বেশি রিফাইন করা যাবে, তত সরকারের লাভ। কারণ, সরকার বেসরকারি রিফাইনারি থেকে বিশ্ববাজারের চেয়ে ১ শতাংশ কম মূল্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনতে পারছে। এখানে সরকারকে ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে না, কারণ, রিফাইনারিগুলো টাকায় তেল দিচ্ছি বিপিসিকে।’ পারটেক্স গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় জ্বালানি আমদানিতে। সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়ন করা গেলে পুরো সক্ষমতায় বেসরকারি রিফাইনারিগুলো উৎপাদন শুরু করতে পারবে। দেশে যে পরিমাণ অকটেনের চাহিদা রয়েছে, তার পুরোটাই দেওয়ার সক্ষমতা বেসরকারি রিফাইনারিগুলোর আছে। এতে অকটেন আমদানির প্রয়োজন হবে না। সাশ্রয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। আমরা সরকারের কাছে বাড়তি কোনো সুবিধা চাই না। আমরা শুধু অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে এক নীতির বাস্তবায়ন চাই। দেশের অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, অবশ্যই অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকদের ব্যবসায় টিকে থাকার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। কারণ, একই দেশে একই পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দুই নীতি থাকলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তাদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু একই পণ্য সেক্ষেত্রে একই ধরনের শুল্ক হওয়া উচিত। এতে সরকারেরও সুবিধা হয়। একই পণ্য একই কোডে একই ধরনের শুল্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আমার মতামত হচ্ছে, এখন যেহেতু বাজারমূল্যের ফর্মুলা অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করবে সুতরাং তাদেরও (অন্তর্বর্তী সরকার) হিসাব করতে সুবিধা হবে যদি একই ধরনের শুল্কায়ন করা হয়।