আবদুস সোবহান গোলাপ। মাদারীপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি। তাঁর বাবা তৈয়ব আলী বেপারী ছিলেন দরিদ্র কৃষক। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে আবদুস সোবহান গোলাপ আশির দশকে পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেখানে পিৎজা বিক্রি ও গাড়ি চালকের চাকরি করতেন। একপর্যায়ে পরিচয় হয় শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করলে গোলাপকে বানানো হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সচিব। এরপর ২০১৪ সালে তাঁকে বানানো হয় বিশেষ সহকারী। ২০১৬ সালে তাঁকে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বানানো হয়। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘রাতের ভোটে’ এমপি নির্বাচিত হন। এরপর শুরু করেন নানা অপকর্ম ও অনিয়ম।
দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে তাঁর নিজের ও স্ত্রীর অর্থসম্পদ চার গুণের বেশি বেড়েছে। মাদারীপুর সদর উপজেলার একাংশ, কালকিনি ও ডাসার উপজেলা নিয়ে মাদারীপুর-৩ নির্বাচনি এলাকা। এখান থেকে ২০১৮ সালে প্রথমবার আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচনি হলফনামায় তাঁর স্ত্রী ও নিজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণী পেশ করেছেন। হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে আবদুস সোবহান গোলাপের নিজের নামে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৩৩ লাখ ৬২ হাজার ৪১৭ এবং স্ত্রীর নামে ৫১ লাখ ৯ হাজার ৬৯০ টাকা জমা ছিল। ২০২৩ সালে তাঁর জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৪৫ লাখ ৩ হাজার ৯৩১ টাকা এবং তাঁর স্ত্রীর নামে রয়েছে ২৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৮ টাকা। ২০১৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী, তাঁর স্ত্রীর কাছে ৯৮ হাজার ১১৮ ইউএস ডলার থাকলেও ২০২৩ সালে তাঁর কাছে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না বলে হলফনামায় দাবি করেন। তবে আবদুস সোবহান গোলাপের ২০১৮ সালের হলফনামা মোতাবেক আগে কোনো গাড়ি ছিল না। ২০২৩ সালের হলফনামা মোতাবেক তাঁর একটি টয়োটা হ্যারিয়ার জিপ রয়েছে। যার বাজারমূল্য উল্লেখ করা হয়েছে ৯০ লাখ ৬৪ হাজার ২৪৭ টাকা। তবে দুর্নীতিতে পিলে চমকানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে শুধু দেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বাড়ি কিনেছেন। কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক সিটিতে প্রায় ৫০ কোটি টাকায় এসব বাড়ি কিনেছেন। এগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্ল্যাট, জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, জমি দখল, সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমা রেখেছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপির ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদনে গোলাপের যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন। ওই বছর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে মোট ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি। আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওসিসিআরপির করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পাঁচটি কন্ডোমিনিয়াম কিনেছিলেন আবদুস সোবহান। সে সময় ওই সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ২৪ লাখ ডলার। এ ছাড়া আশপাশের ভবনগুলোতে ৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার মূল্যের তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন। এগুলোর মালিকানায় রয়েছেন তার স্ত্রী গুলশান আরাও। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন। এর সাত মাস আগে বাংলাদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা : জানা গেছে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন এমপি হয়ে। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেন। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার হারুন শরীফ বলেন, আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিনি না। হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরই শুনি গোলাপ মুক্তিযোদ্ধা।
জমি দখল : গোলাপের বাবা তৈয়ব আলী বেপারীর জমিজমা তেমন ছিল না। তবে গোলাপ এমপি হওয়ার পর শুরু করেন দখলবাজি। নিজ বংশের লোকদের জমিও দখল করেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে মামলা হামলা করে বাড়িছাড়া করা হতো। জমি ফেরত পেতে পাঁচজন বাদী হয়ে মাদারীপুর আদালতে মামলা করেন। তবে মামলা হলেও ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিকার পাননি। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ক্ষতিগ্রস্ত এ বি এম সালাহউদ্দিন, জুলহাস বেপারী, শাহীন সুলতানা, মাসুম বেপারী, মনজুয়ারা বেগম, মুজিবুর রহমান, শাহনাজ বেগম, মশিউর রহমান, মো. কামরুজ্জামানসহ ১০ ব্যক্তি দুদকে একটি অভিযোগ দিয়েছেন। এ বি এম সালাহউদ্দিন বলেন, আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি গোলাপ দখল করে নিয়েছে। আমরা আগে মামলা দিয়েছিলাম, কোনো প্রতিকার পাইনি।
দখল করেছেন মুক্তিযোদ্ধার জমিও : বীর মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম নুরুল আলম সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। তার পৈতৃক জমিও দখল করেছেন গোলাপ। বীর মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম নুরুল আলম বলেন, আমার নিজের জমি দখল করেছেন। বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছি, কিন্তু এখনো কোনো প্রতিকার পাইনি। আমি চাই গোলাপের বিচার হোক।
মনোনয়ন বাণিজ্য : স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন গোলাপ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক প্রদানের জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে একাধিক প্রার্থী থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন গোলাপ। তবে মনোনয়ন প্রদান করতেন একজনকে বাকিদের টাকাও ফেরত দিতেন না। শিকারমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের সিরাজ মাল বলেন, মনোনয়ন দেওয়ার নামে আমার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছেন গোলাপ। আমাকে মনোনয়ন দেননি। টাকাও ফেরত দেননি।
পদবাণিজ্য : গোলাপ দপ্তর সম্পাদক হওয়ার পর দলীয় পদ দেওয়ার নামে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন। এ ছাড়াও শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যুক্ত বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় সংগঠন তৈরির কারিগর ছিলেন গোলাপ। মুরাদ সরদার নামে কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, পদবাণিজ্যের নামে তিনি অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আমার কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন।
টিআর কাবিখা বরাদ্দে অনিয়ম : টিআর কাবিখা বরাদ্দে নানা অনিয়ম করতেন গোলাপ। তার স্ত্রী গুলশান আরার নামেও তুলেছেন টিআরের মালামাল। টিআর ও কাবিখার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন গোলাপ।
সরকারি জমি দখল : কলিকিনিতে দখল করেছেন অনেক সরকারি জমি। নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবন।
বিনা ভোটে দুই ভাইকে ইউপি চেয়ারম্যান বানান : ইউনুস বেপারী ও মিল্টন নামে তার দুই ভাইকে দুই মেয়াদে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান বানান গোলাপ। অন্য প্রার্থীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে যেতে বাধ্য করেন গোলাপ। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রমজানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন আলী নুর তালুকদার। তিনি নির্বাচন অফিসে মনোনয়নপত্র দাখিল করলে তাকে তুলে নিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন। আলী নুর তালুকদার বলেন, আমি চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলাম কিন্তু আমাকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। জোর করে গোলাপ তার ভাইকে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এসব বিষয়ে আবদুস সোবহান গোলাপ বর্তমানে হত্যা মামলায় জেলে থাকায় বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।