মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে চলতে গেলে কখনো কখনো অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এই সহযোগিতার একটি পর্যায় হলো ঋণের আদান-প্রদান। পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত ব্যক্তিকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাকে বিশেষ সহায়তা করা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে উত্তম ঋণ প্রদানের প্রতি যেমন উৎসাহ প্রদান করেছেন, তেমনিভাবে ঋণ আদায়ের ব্যাপারেও দিয়েছেন জোরালো নির্দেশ।
পবিত্র কোরআন মাজিদে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন, মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন ও অসিয়ত পালনের আগেই যেন তার ঋণ পরিশোধ করা হয় (সুরা নিসা-১১ থেকে ১৪)। নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের জানাজা নামাজ পড়াতেন না, যদি তার ঋণ অপরিশোধিত থাকত (বুখারি)। ঋণ প্রদান একটি নেকির কাজ, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে, ঋণ প্রদানের মাধ্যমে মানুষের সাহায্য করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা দূরবিত হয়।
নবীজি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দুনিয়াবি বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ তার আখেরাতের বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর কষ্ট সহজ করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতকে সহজ করে দেবেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বান্দাকে সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে (মুসলিম)। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঋণ গ্রহণ করবে এমন মানুষের অভাব নেই, তবে ঋণ পরিশোধ করার মনমানসিকতা সম্পন্ন মানুষের বড়ই অভাব। অথচ ঋণ গ্রহণ করার পর তা পরিশোধ না করা কবিরা গুনাহ।
হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত নবীজি বলেছেন, আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ কবিরা গুনাহসমূহের পরে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কবিরা গুনাহ হলো কোনো বান্দার আল্লাহর সঙ্গে এমতাবস্থায় সাক্ষাৎ করা যে, তার ওপর ঋণ রয়েছে অথচ পরিশোধযোগ্য কিছুই সে রেখে যায়নি (আবু দাউদ)। নবীজি বলেন, যে ব্যক্তি অহংকার, গনিমতের সম্পদ আত্মসাৎ ও ঋণ এই তিন বিষয় থেকে মুক্ত অবস্থায় মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে (তিরমিজি)। ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুনাহই ক্ষমা করে দেওয়া হবে (মুসলিম)।
নবীজি (সা.) বলেছেন, মুমিন ব্যক্তির রুহ তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করা হয় (ইবনে মাজাহ)। নবীজি সাহাবিদের ঋণ পরিশোধের দোয়া শিখিয়েছেন, আল্লাহুম্মাকফিনি বিহালালিকা আন হারামিকা ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক (অর্থ : হে আল্লাহ আপনি আমাকে আপনার হালাল রিজিকের মাধ্যমে হারাম থেকে বাঁচান এবং আপনার দয়া ও করুণা দিয়ে অন্যদের থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী করে দিন (তিরমিজি)। বর্তমান সমাজে অনেকে ঋণ গ্রহণের পর ওই টাকাকে নিজের সম্পদ মনে করেন অনেকে টাকা আত্মসাৎ এর উদ্দেশে বিভিন্ন ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন।
হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রসুল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা পরিশোধ করার ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হয়ে কেয়ামতের ময়দানে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে (বুখারি)। ইসলামে ঋণ প্রদানের উৎসাহ দিলেও ঋণী হতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে আমরা ঋণ প্রদানে সতর্ক থাকব। ঋণ যেন সুদ মুক্ত হয়, ঋণের বিনিময়ে মূলধনের অতিরিক্ত কোনো রূপ শর্ত আরোপ করা যাবে না। এটিই সুদ যা সম্পূর্ণ হারাম, সাধারণ সুদ ও চক্রবৃদ্ধি সুদ সব একই। আল্লাহ মহান কালামে মাজিদে বলেছেন, আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন (সুরা বাকারা-২৭৫)। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, অতি দীর্ঘমেয়াদে ঋণ না নেওয়া, কারণ মানুষের জীবন স্বল্প মেয়াদি, যে কোনো সময় মৃত্যু এসে যেতে পারে, আগামীকাল পর্যন্ত জীবিত থাকার যেখানে নিশ্চয়তা নেই, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারার নিশ্চয়তা কোথায়। মানুষের জীবনের বাস্তবতা হাদিসে এভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত একদা ওসামা ইবনে জায়েদ এক শত দিনার দিয়ে একটি হালাল প্রাণীর মাদি বাচ্চা ক্রয় করলেন এই আশায় যে, এক মাস পর তা খাওয়ার যোগ্য হবে। নবীজি শুনে বললেন, এক মাস মেয়াদে খরিদকারী ওসামাকে দেখে তোমরা কি অবাক হচ্ছ না, ওসামা তো দীর্ঘ আশা পোষণকারী যার হাতে আমার জীবন, সে আল্লাহর কসম, আমি চোখ মেলে তাকানোর পর ভাবী হয়তো চোখের পাতা মিলিত হওয়ার আগেই আল্লাহ আমার প্রাণ কেড়ে নেবেন, এক পেয়ালা পানি মুখে তুলে পান করার পর ভাবী হয়তো পেয়ালাটা নামানোর আগেই আমি মারা যাব, এক লোকমা খাবার মুখে নেওয়ার পর ভাবী হয়তো ওটা গিলে খাওয়ার আগেই আমার মৃত্যু হয়ে যাবে (শুয়াবুল ঈমান)।
লেখক : খতিব, বাইতুন নূর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, দক্ষিণ পীরেরবাগ অলি মার্কেট, ঢাকা
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন