এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। এতে সারা দেশে পাস করেছেন ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ শিক্ষার্থী। পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। চলতি বছরে অনেক বিষয়ে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এসএসসি ও সমমানের বিষয়ের সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল দেওয়া হয়েছে এইচএসসির পরীক্ষা না হওয়া বিষয়গুলোয়। বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা হয়নি জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতের মতো কঠিন বিষয়ে। মানবিকে পরীক্ষা হয়নি অর্থনীতি, পৌরনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে। আর বাণিজ্য বিভাগে হিসাববিজ্ঞান ছাড়া অন্য বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডে বাংলা, ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষা হলেও সিলেট বোর্ডে হয়নি এ দুই বিষয়েও। অন্য বোর্ডে সাতটি পত্রে পরীক্ষা হলেও সিলেট বোর্ডে মাত্র তিনটির পরীক্ষা হয়েছে। তুলনামূলক কঠিন বিষয়গুলোয় পরীক্ষা না হওয়ায় প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। সে হিসেবে গত বছরের চেয়ে এবার জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছেন ৫৩ হাজার ৩১৬ জন। অনেক বিষয়ে পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উচ্ছ্বাস ছিল না আগের মতো। তবে অনেক কলেজে জড়ো হন ফলপ্রার্থীরা। গতকাল বেলা ১১টায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার শিক্ষা বোর্ডে সংবাদ সম্মেলন করে এ ফল প্রকাশ করেন। ফল প্রকাশ মূলত শিক্ষা বোর্ডের কাজ হলেও এর আগে প্রধানমন্ত্রী ফল প্রকাশ করতেন। আর শিক্ষামন্ত্রীরা সংবাদ সম্মেলন করে এর বিস্তারিত তুলে ধরতেন। এ নিয়ে অসন্তোষ ছিল অনেকের। তবে বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা ফল প্রকাশের দায়িত্ব শিক্ষা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত করেন। ফলে রীতি ভেঙে গতকাল ফল প্রকাশ করে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এইচএসসি ও সমমানে সারা দেশে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ জন পাস করেছেন। গত বছর ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছিলেন ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন। গত বছর পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে এ বছর পাসের হার কমেছে শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ।
গ্রুপভিত্তিক ফলাফলে দেখা গেছে, বিজ্ঞান বিভাগে ২ লাখ ৯১ হাজার ৮৩ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছেন ৯২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। মানবিকে ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫১৭ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৬৮ দশমিক ৭১ শতাংশ পাস করেছেন। আর বাণিজ্য বিভাগে ২ লাখ ৬ হাজার ৫১৮ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছেন ৭২ দশমিক ৪২ শতাংশ। রাজধানীর সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবারও কৃতিত্বের ধারা অব্যাহত রেখেছে। এইচএসসিতে ৮১২ জন জিপিএ-৫সহ শতভাগ পাসের গৌরব অর্জন করেছে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘এবার নানানরকম প্রতিকূলতার মধ্যে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যেও তারা আশানুরূপ ফল অর্জন করেছে। শিক্ষকদের সযত্ন পরিচর্যা আর শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় এ ফল সম্ভব হয়েছে।’ কলেজটির গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রী সাবরিনা ইসলাম তিনা বলেন, ‘আমার আশা শতভাগ পূর্ণ হয়েছে। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও আমার চেষ্টায় ভালো ফল হয়েছে।’ এদিকে রাজধানীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের মোট ২ হাজার ৭৪০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শতভাগ পাস করেছেন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৭৬৫ জন। দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসার ১ হাজার ২০৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৬১ জন। পাসের হার ৯৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর ২ হাজার ৫৫৯ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৯৯ দশমিক ০৬ শতাংশ পাস করেছেন। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৭৩৭ জন। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১ হাজার ৬০৩ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছেন ৯৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭৮০ জন। মাইলস্টোন কলেজ থেকে ৩ হাজার ১০৭ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শতভাগ পাস করেছেন। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২ হাজার জন।
পাসের হারে এগিয়ে সিলেট বোর্ড : প্রায় প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় বোর্ডভিত্তিক ফলাফলে সিলেট বিভাগ পিছিয়ে থাকলেও এবার উল্টো ঘটেছে। এইচএসসির ফলাফলে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে সিলেট বোর্ড সবচেয়ে ভালো করেছে। এ বোর্ডে পাসের হার সর্বোচ্চ ৮৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম পাস করেছে ময়মনসিংহ বোর্ডে। এ বোর্ডে ৬৩ দশমিক ২২ শতাংশ পাস করেছে। এ ছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ২১, রাজশাহীতে ৮১ দশমিক ২৪, কুমিল্লায় ৭১ দশমিক ১৫, যশোরে ৬৪ দশমিক ২৯, চট্টগ্রামে ৭০ দশমিক ৩২, বরিশালে ৮১ দশমিক ৮৫ আর দিনাজপুরে ৭৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ পাস করেছে। মাদরাসা বোর্ডে আলিমে ৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও কারিগরি বোর্ডে ৮৮ দশমিক ০৯ শতাংশ পাস করেছে।
পাসের হার ও জিপিএ-৫-এ এগিয়ে মেয়েরা : এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবারও পাসের হার ও জিপিএ-৫-এ এগিয়ে রয়েছেন মেয়েরা। এ বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ছাত্রী অংশ নেন ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫ জন। তার মধ্যে উত্তীর্ণ হন ৫ লাখ ৩১ হাজার ৭১৪ জন, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৮০ হাজার ৯৩৩ জন। এদিকে, পরীক্ষায় ছাত্র অংশ নেন ৬ লাখ ৬৬ হাজার ১৩ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হন ৫ লাখ ৩ হাজার ৫৯৫ জন। আর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৪ হাজার ৯৭৮ জন। ছাত্রদের তুলনায় ১৫ হাজার ৯৫৫ জন জিপিএ-৫ বেশি পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন ছাত্রীরা।
শতভাগ পাস ১ হাজার ৩৮৮টিতে, সব ফেল ৬৫টিতে : এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় দেশের ৬৫ প্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করেনি। আর শতভাগ পাস করেছে ১ হাজার ৩৮৮টি প্রতিষ্ঠানে। গত বছর শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৪২। আর শতভাগ পাস করেছিল ৯৫৩টিতে।
পুনর্নিরীক্ষণ আবেদন শুরু আজ : টেলিটক সিম ব্যবহার করে এসএমএসের মাধ্যমে আজ থেকেই এইচএসসি ও সমমানের ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। এ প্রক্রিয়া চলবে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত।
বিদেশ কেন্দ্রে পাসের হার ৯৫.৩৯ শতাংশ : এ বছর আটটি বিদেশ কেন্দ্রে ২৮২ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন ২৬৯ জন। পাসের হার ৯৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় ৩০ জুন। কয়েকটি পরীক্ষার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পতন হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের। নতুন সরকার গঠনের পর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। তবে আগস্টে সচিবালয়ের ভিতরে ঢুকে পরীক্ষা না নিয়ে পাসের দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ করেন। পরে স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।