দেশের ২১টি সীমান্ত এলাকা ও একটি উপকূলীয় জেলা যেন অবৈধ অস্ত্রের হাটবাজার। অনেকটা প্রকাশ্যেই সেখানে অবৈধ অস্ত্র বিকিকিনি চলে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিদেশি অস্ত্রের পাশাপাশি দেশেও তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র। আর এ অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সংঘটিত হচ্ছে খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর সব অপরাধ। এসব অপরাধের কারণে সামাজিক নিরাপত্তা যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি স্বাভাবিক জনজীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
৩১ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডায় সংঘটিত তিন খুন, মঙ্গলবার রাতে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে যুবলীগ নেতা আবদুল মান্নান হত্যাকাণ্ডে খুনিরা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে। এ ছাড়া মাগুরায় মাতৃগর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো অবৈধ বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। কিন্তু এ অস্ত্রগুলো পুলিশ বা র্যাব উদ্ধার করতে পারেনি।
আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে গেছে। এমনি অবস্থায় সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা অবৈধ অস্ত্রের চোরাকারবারি ও তাদের গডফাদারদের নামের তালিকা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জমা দিয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদন পুলিশের মহাপরিদর্শক ও বিজিবির মহাপরিচালককে দেওয়া হয়। ভারত থেকে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি ও এর সঙ্গে জড়িতদের নাম-ঠিকানা প্রসঙ্গে বিশেষ প্রতিবেদন শীর্ষক ওই গোপন প্রতিবেদনের উদ্ধৃতাংশের আলোকে প্রদত্ত তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ ও র্যাবকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু গোয়েন্দাদের তালিকায় স্থান পাওয়া অবৈধ অস্ত্রের কারবারিরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এবং উপকূলীয় বরিশালের বিভিন্ন স্থান দিয়ে প্রতিদিন ছোট-বড় শত শত অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। অস্ত্র চোরাকারবারিরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছে যেমন আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছেন তেমনি কোনো কোনো অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের আশীর্বাদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ কারবার চালিয়ে আসছেন। অনেক সময় গডফাদারদের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও পারেন না। অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান এবং এর ব্যবহারের ওপর নজরদারি করা একটি বেসরকারি সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, দেশে কমপক্ষে ১২৪টি বড় ধরনের অপরাধী চক্র ছিল বা আছে, এর ২৪টিরও বেশি ঢাকায়। তাদের কাছে কম-বেশি ৩ লাখ ২০ হাজার থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার অবৈধ ক্ষুদ্রাস্ত্র রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে দেখা গেছে, এ অস্ত্রের শতকরা ৬০ ভাগ ব্যবহার করে মূলধারার রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি) ক্যাডাররা। ৩০ ভাগ অস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসীদের কাছে। এর মধ্যে আছে পার্বত্য বিদ্রোহী ও রোহিঙ্গারা। আর ১০ ভাগ অস্ত্র আছে সাধারণ অপরাধীদের (চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী) কাছে। অবৈধ অস্ত্রের অর্ধেক (শতকরা ৫০ ভাগ) ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে তৈরি এলজি ও কাটা রাইফেল। ৩০ ভাগ পিস্তল ও রিভলবার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার তৈরি। আর ১০ ভাগ হালকার মধ্যে বড় অস্ত্র অর্থাৎ রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগান (একে-৪৭, একে ২২, জি-৩ ও এম-১৬) প্রভৃতি পার্বত্য বিদ্রোহী, রোহিঙ্গা এবং কিছু শিবির ক্যাডারের হাতে রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, দেশে প্রায় ১০ হাজার পেশাদার সন্ত্রাসীর হাতে লাইসেন্স করা বা টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করা অত্যাধুনিক ৯ এমএম পিস্তল রয়েছে। র্যাব সৃষ্টির পর অনেকে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ও অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী পালিয়ে গেলেও নতুন করে অনেক সন্ত্রাসী মাঠে নেমে শূন্যস্থান পূরণ করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে সন্ত্রাসীরা সব সময় সরকারি দলে এবং পুলিশের আশ্রয়ে থাকে। পুলিশের আশ্রয়ে যারা থাকে তারা সোর্স নাম নিয়ে থাকে, তবে সোর্সদের বড় অংশই সন্ত্রাসী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিএসএফ-প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত থেকে আসা ফল ও পিয়াজের গাড়িতে অনেক সময় ওই দেশের চোরাকারবারিরা দু-একটি করে অস্ত্র পাঠিয়ে দেয়। আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নজরদারি করার কথা বলেছি, যাতে ওই দেশের চোরাকারবারিরা বাংলাদেশে অস্ত্রের চালান পাঠাতে না পারে। র্যাবের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তারা চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত অস্ত্রসংক্রান্ত মামলায় ৩৬৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। উদ্ধার করেছে বিভিন্ন ধরনের ৪৭৬টি অস্ত্র। এ প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, র্যাব সৃষ্টির পর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। কারণ, র্যাব মনে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিকল্প নেই। তাই গোয়েন্দা ও অভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে বিভিন্ন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে চলেছে।