শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ভ্রমণ

মেকং নদীর বালুচরে

মঈনুস সুলতান

মেকং নদীর বালুচরে

জলে খেলছে আধ ন্যাংটা শিশু

মেকং নদী এখানে কেন জানি বিভাজিত হয়ে সৃষ্টি করেছে অতিরিক্ত একটি অগভীর ঝিরঝির জলের শাখা। তাতে আস্ত একটি ভূভাগ লাওসের রাজধানী ভিয়েনচান শহরের প্রান্তিকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি করেছে বালুচরে ঘেরা সবুজ দ্বীপের। এখানে বেশ ক’ঘর মৎস্যজীবী লাওলুম গোত্রের মানুষের বাস। বাঁশবনের ছায়াঘন পরিবেশে তাদের খুঁটির ওপর কাঠ ও শনের ঘরদুয়ার। কারও আঙ্গিনায় নারিকেলের চিরল চিরল পাতায় সারা দিনমান খেলে যায় ধু-ধু হাওয়া। বর্ষায় বালুচর ডুবে গিয়ে শাখা নদীতে বয়ে চলে অল্পবিস্তর স্রোত। খেয়া পারাপারের কোনো বন্দোবস্ত নেই বলে ভরসা করতে হয় সেই ফরাসি ঔপনিবেশিক জামানায় তৈরি বেজায় হিলহিলে একটি কাঠের ব্রিজের ওপর। ব্রিজটির স্থানে স্থানে কাঠ ক্ষয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে ফাঁকফোকর। রেলিংও ভেঙে ঝুলে আছে আলগা সব টুকরা কাঠ। আমি সাবধানে এক পা দুই পা করে সামনে বাড়ি। আমার পাশ দিয়ে একটি ফিফটি সিসি হোন্ডা বাইক এঁকেবেঁকে ফাঁকফোকর অতিক্রম সামনে ছুটলে সারা ব্রিজ নড়বড়ে দাঁতের মতো হিলহিল করে ওঠে। কোনোক্রমে এ পাড়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে দ্বীপে নামতে নামতে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। সিঁড়ির শেষ ধাপের সঙ্গে লাগোয়া ফরাসি ঔপনিবেশিক জামানায় নির্মিত ওয়াটার টাওয়ার, ট্যাংকের ঠিক নিচে সিমেন্টে বাঁধানো নোনা ধরা প্ল্যাটফর্ম। তাতে বসে এক মহিলা শিকে গেঁথে গ্রিল করছে তাজা মাছ। মহিলার সামনে চাটাইয়ে রাখা কলাপাতায় পাপাইয়া সালাদ। এ নারীর চোখে দৃষ্টির অভাব বলে সে রোদের দিকে ঘোলাটে মণি মিরমির করে গ্রিল করতে করতে হামানদিস্তায় কুটে চলে শুকনা কুঁচো চিংড়ির সঙ্গে কাঁচা মরিচ, আদা, ধনেপাতা আর লেবুর টুকরা।

ওয়াটার ট্যাংকের নিচে নাঙ ঋতুমণির দাঁড়িয়ে থাকার কথা। মাত্র তিন দিন আগে তার সঙ্গে পাকা কথা হয়েছে। ভিয়েনচান শহরের একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত হয়েছিল ফটোগ্রাফি শেখার ওয়ার্কশপের। নাঙ ঋতুমণি সেখানে এসেছিল যারপরনাই সস্তা একটি ক্যামেরা নিয়ে। কিন্তু তার একটি ছবিতে স্পষ্টত বিষয় নির্বাচনের দক্ষতা আমাকে আকর্ষণ করেছিল। ফটোগ্রাফে দুটি খোরগোশের বাচ্চা কুটকুট করে ঘাস খাচ্ছে। আমি লাও ভাষায় খোরগোশ ঘাস খাচ্ছে বলতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে বলে ফেলি ঘাস খরগোশ খাচ্ছে। তাতে নাঙ ঋতুমণি হেসে উঠে খিলখিলিয়ে। তাতে মেঘে ছড়িয়ে পড়া সূর্যের বর্ণালির মতো মেকাপের স্তর ভেদ করে মেয়েটির দুই গালে ফুটে উঠেছিল খানিক লজ্জার অরুণাভা। আমি অনেক দিন ধরে খরগোশ পোষার কথা ভাবছি এ তথ্য তাকে জানালে সে বলে যে, তাদের বাড়িতে দুটি খরগোশ একসঙ্গে বিয়িয়েছ, আঙ্গিনায় পায়ে পায়ে ঘুরছে পাঁচটি বাচ্চা খরগোশ। আমি দ্বীপে এলে সে আমাকে এমনিই দিয়ে দিতে পারবে দুটি বাচ্চা। তার ধূসর বর্ণের চোখের অসাধারণ অস্থিরতা আমাকে খুব করে টানে। ঠিক তখনই সে আরেকটি ছবি আমাকে দেখায়। দ্বীপ থেকে অল্প দূরে মেকং নদীতে ভাসছে এক চিলতে ডাঙ্গা। তাতে হুটোপুটি করে খেলছে কটি আধ ন্যাংটা ছেলেমেয়ে। আমি ওখানে যেতে চাইলে সে বলেÑ তা আর কঠিন কি, আমাদের তো নৌকা আছে, দ্বীপে আসো, বৈঠা মেরে ওখানে নিয়ে যাব না হয়। আমি খুশি হয়ে আমার ক্যামেরায় কিভাবে অটোতে নিজের ছবি তোলা যায় তা দেখিয়ে দিলে সে ক্যামেরা অটোতে দিয়ে খুব সংলগ্ন হয়ে আমার পাশে বসে। ফ্লাশ ঝলকালে মেয়েটির খুব কাছে বসেছি বলে আমাদের দুজনের এক ধরনের এক্সাইটমেন্টও হয়।

আজ আমি অটোতে যুগলে তোলা ছবির প্রিন্ট নিয়ে খরগোশের বাচ্চা সংগ্রহ করতে এ দ্বীপে এসেছি। তাকে ট্যাংকের নিচে দেখতে না পেয়ে একটু বিরক্ত হই। তারপর কি ভেবে কিনি শিকে গাঁথা ঝলসানো দুটি মাছ ও খানিক পাপাইয়া সালাদ। চোখে আলোহীন নারী আমার হাতে পাপাইয়া সালাদ তুলে দিতে দিতে বলেÑ মঁশিয়ো, নাঙ ঋতুমণির ঘর ঠিক সামনেই, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সে কেবল ঘরে ফিরেছে। ছোট্ট এ সওদাপাতি হাতে নিতেই কাঁচামরিচ, লেবু ও ধনেপাতার পানজেন্ট সৌরভে সারা মন ভরে ওঠে। খানিক আলগা উৎসাহ নিয়ে আমি নাঙ ঋতুমণির আঙ্গিনায় এসে দাঁড়াই। দুটি আম গাছের সঙ্গে বাঁধা দড়ির হ্যামক বা দোলনা, তাতে দাঁড়িয়ে হাঁটু অব্দি ঝুলের পাছাপেড়ে পাছিন পরা মেয়েটি হিলিহিলিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে গাছ থেকে পাড়ছে পাকা আম, আর তাতে ক্রমাগত দুলছে তার অনতিউচ্চ দুটি স্তন। আমাকে দেখেই সে হেসে উঠে খিলখিলিয়ে।

আজ নাঙ ঋতুমণি মেকাপ করেনি একেবারেই। অটোতে যুগলে তোলা ছবি দেখে তার ধূসর দৃষ্টিতে ফুটে রহস্যময় কৌতূহল। কোমরের বেল্টে গোঁজা কাটাইল দিয়ে আম ছুলে সে আমার হাতে দেয়। আমি হ্যামকে বসিÑ বাবা তার বড় নাও খানা নিয়ে মেকং নদীতে গেছে মাছ ধরতে। বাড়িতে কেউ নেই। মা তো চোখে তেমন একটা দেখে না, সে ট্যাংকের নিচে বসে বিক্রি করছে ঝলসানো মাছ ও পাপাইয়া সালাদ। সংসারের টুকিটাকি কথা বলতে বলতে নাঙ ঋতুমণি দুটি বাচ্চা খরগোশ এনে আমার কোলের ওপর ছেড়ে দিয়ে সে হ্যামকে আমার পাশে বসে। তুলতুলে পশমের বাচ্চা দুটি আমার গতর বেয়ে বুকে উঠছে। নাঙ ঋতুমণি আমার হাত ধরে বলেÑ একটি ছোট্ট অনুরোধ, এ বাচ্চা দুটিকে আমি ‘অনিওন’ আর ‘গার্লিক’ বা ‘পেঁয়াজ’ ও ‘রসুন’ বলে ডাকি, মঁশিয়ো তুমি কিন্তু কাইন্ডলি তাদের নাম বদলাবে না। আমি তার কব্জি মৃদু টিপে দিয়ে প্রস্তাবে রাজি হয়ে বলি, তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে মেকংয়ে ভাসা ডাঙ্গায় নিয়ে যাবে? আমি যে ক্যামেরা নিয়ে এসেছি। সে উঠে দাঁড়িয়ে চল নাও ভাসাই, বলে তার তৎক্ষণাৎ প্রস্তুতির কথা জানায়।

নারিকেল কুঞ্জের আড়ালে মেকং নদী মোচড় খেয়ে তৈরি করেছে অগভীর দহ। তাতে জেগে আছে টুকরো টুকরো স্থল, জলে যেন ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি আস্ত গাছ। পাড়ের দীর্ঘ ঘাসে বসা বকদের উড়িয়ে দিয়ে আমরা গাছ কুঁদে তৈরি তালডোঙ্গা ভাসাই। মেকংয়ে পড়তেই স্রোতের টান একটু বাড়ে। বৈঠা বাইতে বাইতে নাঙ ঋতুমণি চোখ মিরমির করে সূর্য ঝলসানো ঘোলা জলের দিকে তাকায়। এ বয়সে তো তার চোখে ছানি পড়ার কথা নয়। স্পষ্টত তার চোখে সমস্যা আছে। ঠিক বুঝতে পারি না সে কি তার মায়ের দেহ থেকে জেনেটিক্যালি বহন করছে কোনো চক্ষু ব্যাধি? দূরের নৌকা থেকে জেলে নদীতে জাল ছুড়ছে। একটি ইঞ্জিনবোট ঢেউ তুলে চলে যায় ওপারে। ডাঙ্গায় পৌঁছে আমরা তালডোঙ্গা টেনে তুলি বালুচরে। এ ডাঙ্গায় বিস্তর হালকা ঝোপঝাড়ে বুনোফুল, আর উড়ছে প্রচুর ঘাসফড়িং। চরের মাঝামাঝি নিচু জমিতে জল জমে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট নহর, তাতে ভেসে বেড়াচ্ছে ডানকানা মাছ আর ব্যাঙের ছানা। আমরা তার পাড়ে বসে গ্রিল করা মাছের সঙ্গে পাপাইয়া সালাদ দিয়ে পিকনিক সারি। সূর্যের আলোয় তার সেনসেটিভ চোখ দুটি ঝলসে যাচ্ছে দেখে আমি আমার রোদচশমা তাকে পরিয়ে দিলে সে ম্লান হেসে বলেÑ এক সময় নাও বেয়ে এ ডাঙ্গায় খুব আসতাম। আজকাল চোখে ঝামেলা হচ্ছে বলে আর তেমন একটা আসা হয় না।

আমি তাকে রোদ বাঁচানোর জন্য আমার হ্যাট পরিয়ে দিলে সে বালু খুঁড়ে ঘর তৈরি করতে বসে। আমি চর থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসি পাথর আর জলে ভেসে আসা কাঠের টুকরা। সে এসব দিয়ে খুব যতেœ খেলাছলে তৈরি করে এক মন্দির। তার পেছনে বালু দিয়ে বানায় টিলা। তারপর টিলাটির বালুকায় পানি মিশিয়ে কাদা ছেনে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি গড়ে। আমি ঠিক তার তলায় কাঠের টুকরা দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে তৈরি করি কৃত্রিম সরোবর। তালডোঙ্গা নাওয়ের সেঁউতি দিয়ে নহর থেকে পানি ক্যারি করে আনলে কৃত্রিম হ্রদে জল টলমল করে ওঠে। দেখি তাতে সাঁতার কাটছে তিনটি ডানকানা মাছ। পানি থির হয়ে আসতেই সরোবরে ছায়া পড়ে ধ্যানস্থ গৌতম বুদ্ধের। ঋতুমণি অবাক হয়ে প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে জোড় হাতে প্রণত হয়।

কিছুক্ষণ যেন সে আনমনা হয়ে কীভাবে। তারপর আমার দিকে তাকায়। মিরমির করে চোখের কুয়াশাকে আরও গভীর করে বলে দ্বীপে বড় আলো, তোমার মুখখানা আমি ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। চল ডোঙ্গা ভাসাই। ওপারে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একবার তোমার দিকে তাকাব। আর তুমি কিছু মনে না করলে ক্যামেরায় তোমার একটি ছবি তুলে রাখব। আমি হাত ধরে তাকে বালুকা থেকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করি। ডোঙ্গায় বসে বৈঠা হাতে নিতে নিতে সে আবার বলেÑ বাবা হয়তো মাছ নিয়ে ফিরেছে। এখন মা ঘরে ফিরে হ্যামকে শুয়ে বিশ্রাম করবে। আর আমি এ বেলা দোকানে বসে আরও কিছু মাছ গ্রিল করব। তুমি চাইলে ট্যাংকের নিচে আমার পাশে আরও একটু সময় বসতেও পার। থেকে যাও না আরও কিছুক্ষণ এখানে। আমার সঙ্গে তো দেখা করতে কখনো কেউ আসে না। তুমি বিকালটা এখানে কাটিয়ে গেলে আমার কী যে ভালো লাগবে।

সাড়ে ৫টার দিকে অস্ট্রেলিয়ান ক্লাবে আমার একজনের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট আছে। না গেলেই চলে না। বিষয়টা তাকে খুব পোলাইটভাবে বুঝিয়ে বলতে হয়। মনের ভিতর লাও ভাষায় কয়েকটি বাক্য গুছিয়ে বলার জন্য তৈরি করে নাঙ ঋতুমণির দিকে তাকালে দেখি সে বৈঠায় জল কাটতে কাটতে আমার জবাবের জন্য ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর