প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চার দিনের সফরে এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। লন্ডনে তাঁর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি রয়েছে। সেখানে তিনি মর্যাদাপূর্ণ হারমনি পদক গ্রহণ করবেন রাজা চার্লসের কাছ থেকে। এ ছাড়াও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের সঙ্গে তাঁর সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক ঘিরে আগ্রহ তৈরি হয়েছে এ দেশের মানুষের। অনেকেই মনে করছেন, এই বৈঠক হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথযাত্রার নব সূচনা। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা এবং একটি অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তার অবসান হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। উল্লেখ্য, ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ই প্রথম লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাক্ষাতের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, ১৩ জুন এই সাক্ষাৎ হতে পারে। গতরাতে (মঙ্গলবার) বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এই বৈঠকের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আসন্ন এই বৈঠক বর্তমান পরিস্থিতি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার দিয়েছে স্থায়ী কমিটি।
বিএনপি বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় দলই শুধু নয়, সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক দলও বটে। গণতন্ত্র রক্ষায় দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দলটি এখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একটি প্রাণশক্তিতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের নতুন কাণ্ডারি। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত বন্দরে পৌঁছে যাবে বলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। কিন্তু গত ১০ মাসে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ড. ইউনূস যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তখন দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তাঁর নেতৃত্ব সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু সেই জনসমর্থন এখন কমেছে। বিবিসির জরিপ অনুযায়ী এখন ৫০ শতাংশের কিছু কম মানুষ ড. ইউনূসকে সমর্থন করছেন। কিন্তু তারপরও ড. ইউনূসের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর এখনো আস্থা এবং বিশ্বাস রয়েছে। তিনি বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের সোনালি বন্দরে নিয়ে যেতে পারবেন বলেই সবার বিশ্বাস। আর এরকম একটি বাস্তবতায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এই বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং পথযাত্রার একটি সুনির্দিষ্ট পথরেখা পাওয়া যাবে বলে অনেকে আশা করছেন।
বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাইছে। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা ঈদের আগের দিন জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে আকস্মিকভাবে আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এই ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল তাঁর এই সিদ্ধান্তকে একতরফা এবং বিশেষ গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্যই দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। এরকম এক বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপির একাধিক নেতা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরপরই স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ভাষণের কিছু শব্দচয়নকে ভব্যতা সীমার বাইরে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর এরকম টানাপোড়েন দেশের গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী বিএনপিকে সমর্থন করে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলটি এখন কেবল জনপ্রিয়ই নয়, এ মুহূর্তে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এরকম একটি রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে পাশ কাটিয়ে যখন প্রধান উপদেষ্টা একটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন তখন তা রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক সৃষ্টি করবেই। অনেকেই মনে করছেন এরকম একতরফা নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ দুটি রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। এই বাস্তবতায় যখন রাজনীতিতে একটি অনিশ্চয়তা, ঠিক সে সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা জানি না এই বৈঠকের আলোচ্যসূচি কী হতে যাচ্ছে বা কী হতে পারে। এই বৈঠকের ফলাফল কী হবে সেটিও এখন অনুমান করা কঠিন। তবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই ব্যক্তি, একসঙ্গে মিলিত হয়ে কথা বলছেন, এটি গণতন্ত্রের জন্য একটি শুভ সংকেত। দেশবাসী প্রত্যাশা করে, এটি যদি সৌজন্য সাক্ষাৎও হয় তাহলে এই সৌজন্য সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণ নিয়ে যে ভুল বোঝাবোঝি তৈরি হয়েছে তার অবসান ঘটবে। বাংলাদেশ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তিনি শান্তিতে নোবেলজয়ী এবং তাঁর বিচক্ষণতা, দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর অনেকেই তাঁকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন বলে কোনো কোনো মহল অভিযোগ করেছে। বিশেষ করে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা একটি মহল দেশে নির্বাচন না করে দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেন। এরকম অবস্থার কারণে ড. ইউনূসের সরকার বিশেষগোষ্ঠী এবং স্বার্থের কাছে বশ্যতা স্বীকার করছেন বলে কারও কারও ধারণা। কেউ কেউ মনে করেন, ড. ইউনূসকে অনেকে ভুল পথে পরিচালনা করার প্ররোচনা দিচ্ছে। এ জন্য তাঁর দরকার সঠিক পরামর্শ এবং সাহচর্য। সে ক্ষেত্রে তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের এই বৈঠক দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভুল বোঝাবুঝির অবসানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। এর ফলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো রাজনৈতিক অঙ্গনের সত্যিকারের অবস্থানটি বুঝতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী তিনি কর্ম-পরিকল্পনা সংশোধন করবেন। কারণ তারেক রহমান সারা দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলেন। তিনি দেশের প্রকৃতচিত্র প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরতে পারবেন। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টাও তাঁর সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা খোলা মনে বলবেন বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। এতে দেশের সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমরা জানি, এপ্রিল মাসে প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাই চূড়ান্ত নয়। কারণ এর আগেও তিনি বলেছিলেন, ডিসেম্বর থেকে জুন মাসে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ডিসেম্বর থেকে জুনের নির্বাচন তিনি যেহেতু এপ্রিলে নিয়ে আসতে পেরেছেন সেহেতু এটি যে নভেম্বর বা ডিসেম্বরে নিয়ে আসা যাবে না তেমনটি নয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুই সম্ভব। আমরা আশা করি, উভয় পক্ষ এখানে দেশের গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ নিয়ে আলোচনা করবেন। কারণ দেশের সাধারণ মানুষ গত ১০ মাসে আসলে ভালো নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। দেশের ব্যবসাবাণিজ্য নেই বললেই চলে। ব্যবসায়ীরা রীতিমতো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তারা ব্যবসাবাণিজ্য সবকিছু বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছেন। অর্থনীতি এখন শুধু রেমিট্যান্সনির্ভর। প্রবাসী আয়ও সামনের দিনগুলোতে সংকটে পড়তে পারে বলে অনেকে অনুমান করছেন। কারণ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগগুলো সংকুচিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ভিসা সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। কথায় কথায় নানা রকম অবস্থান কর্মসূচি, দাবি-দাওয়া নিয়ে অস্থিরতা দেশকে একটি অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা যখন লন্ডনে তখন তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনা এবং সচিবালয় সংলগ্ন এলাকাগুলোতে সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই ছুটির মধ্যে কেন? এর কারণ হলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে সিদ্ধান্ত নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সেজন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ই একমাত্র দায়ী। এ ছাড়াও সচিবালয়ের কর্মচারীরা ঈদের ছুটি পর্যন্ত আন্দোলনে ছিলেন। ঈদের পর এসব আন্দোলন এবং দাবি-দাওয়া বাড়তেই থাকবে। সর্বত্র এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। এখান থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আবার নির্বাচনের আগে জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচার পতিত ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঠেকানো এবং রাষ্ট্র-সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো বিষয়। সরকার কোনো বিষয়েই সফল হবে না, যদি বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ না রাখতে পারে। তাদের আস্থায় না নিতে পারে। আর এ কারণেই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারেক রহমান এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ রাজনৈতিক দলের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বিএনপিকে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন করে গড়েছেন। কাজেই তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা এবং ড. ইউনূসের প্রজ্ঞা দুটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন পথের সন্ধান করতে পারে। বৈঠকটি নানা কারণে সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের কাণ্ডারি এ দুজন দেশকে পথ দেখাবেন এবং তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের নবযাত্রার পথ-নির্দেশক হবেন।
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : [email protected]