নদী-খাল বিলের দেশ বাংলাদেশ। নদীমাতৃক এই দেশে জীবনের সাথে মিশে আছে নৌকা। কারণ নৌপথে যাতায়াতের অন্যতম বাহন নৌকা। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ নদ-নদী মৃত প্রায়। সেই সাথে নদীর উপর ব্রীজ নির্মাণের ফলে যান্ত্রিকতার সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে নৌকার ব্যবহার। তবে অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতাসহ বৈশ্বিক জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কদর বেড়েছে নৌকার। আর এ কারণেই প্রতিবছর জমজমাট থাকে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটার নৌকা পল্লী।
পাটকেলঘাটার বলফিল্ড মোড় থেকে পেট্রলপাম্প পর্যন্ত ২০টি কারখানায় বছরজুড়েই চলে নৌকা তৈরির কাজ। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হয় পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে। তবে সুন্দরবনে দস্যুতা বাড়ায় কমেছে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের সংখ্যা। প্রতিনিয়ত ঘটছে মুক্তিপণ ও মারধরের ঘটনা। ফলে জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে যেতে অনাগ্রহ দেখা দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে নৌকা শিল্পে।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটায় নৌকা তৈরির বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে জানা গেছে, দুই দশক আগে থেকে পাটকেলঘাটার বলফিল্ড এলাকায় ও কপোতাক্ষের তীরে গড়ে উঠেছে কাঠের নৌকা পল্লী। এখানকার ২০টি কারখানায় খৈ, কড়ই, চাম্বুল, পুই, লাম্বু ও মেহগনি কাঠ দিয়ে ও ধাতু দ্রব্য পেরেক, তারকাটা, জলুয়া ব্যাবহার করে দক্ষ হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় শৈল্পিক সৌন্দর্যে তৈরি হয় এসব নৌকা। বিভিন্ন আকারের মজবুত ডিঙ্গি, কোষা, ডামবুরি, খেঁয়া ও সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া বড় বড় গহনার নৌকা তৈরীতে ব্যস্থ সময় পার করছেন কারিগররা।
দিনভর হাতুড়ি,বাটালি’র খটখটানি শব্দে মুখরিত থাকে সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের পাটকেলঘাটার বলফিল্ড বাসস্টান্ড এলাকা থেকে পেট্রলপাম্প পর্যন্ত এই নৌকা পল্লী। এছাড়া পাটকেলঘাটা ব্রীজের নীচে কপোতাক্ষ নদের তীরে বেড়িবাঁদের উপর তৈরী হয়ে থাকে বিভিন্ন আকৃতির ছোট-বড় নৌকা। দুই থেকে তিনজন মিলে এক একটি ডিঙ্গি ও কোষা নৌকা তৈরী করতে সময় নেয় এক থেকে দুই দিন। নৌকার আকার ভেদে যার মূল্য ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
ডিঙ্গি, কোষা ও খেঁয়া নৌকার পাশাপাশি সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া বড় বড় সামদ্রিক নৌকা। একটি বড় সামদ্রিক নৌকা তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় দেড় মাস। যার এক একটির মূল্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। খরচ বাদে লাভ হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। আর এসব নৌকা তৈরি করে বেশ সাবলম্বী হয়েছেন এখানকার কারিগর ও কারখানা মালিকরা। সাতক্ষীরা ছাড়াও যশোর, খুলনা, বরিশালসহ দেশের নদী তীরবর্তী বন্যা ও জলোবদ্বতায় আক্রান্ত বিভিন্ন এলাকার মানুষ নৌকা কিনতে আসেন পাটকেলঘাটার এই নৌকার হাটে। সারা বছরের ন্যায় বর্ষা মৌসুমে নৌকার চাহিদা থাকে অনেক বেশি।
মেসার্স ঐশী নৌকা কারখানার মালিক শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা ১৯৯৮ সাল থেকে নৌকা তৈরি করি। তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ার কারণে নৌকার বেচা-বিক্রি বেশি হয়েছিলো। বর্তমানে এখানে নৌকার হাট গড়ে উঠেছে। কোষা ৯-১০ফুট আর ডিঙি নৌকা ১৫-১৬ ফুট দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে। ছোট নৗকার মূল্য ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার, আর ৪৫ হাত লম্বা ইঞ্জিন চলিত সামদ্রিক নৌকার মূল্য প্রায় ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকা। বন্যা ও অতিবৃষ্টি হলে নৌকার চাহিদা তুলনামূলক অনেক বাড়ে। তখন দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন অনেক মানুষ নৌকা কিনতে আসে। তাদের চাহিদানুযায়ী নৌকা সরবরাহ করতে আমাদের অনেক সময় হিমশিম খাই। কারণ নৌকা তৈরিতে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগাড় করতে একটু সময় লাগে।
কারখানায় কর্মরত স্থানীয় কারিগর যুগীপুকুরিয়া গ্রামের ইমন ও মামুন গাজী জানান, বছর জুড়েই তারা নৌকা তৈরি করেন। মেহগনি, খৈ, চম্বল, লম্বু, কড়াই কাঠ দিয়ে টেকসই মজবুত একটি ছোট ও মাঝারি সাইজের নৌকা তৈরি করে তারা মুজুরি পান তিন হাজার টাকা।
যশোর জেলার শার্শা থেকে নৌকা কিনতে আসা কাওসার আলী জানান, নৌকা দিয়ে নদীতে মাছ ধরেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। পাটকেলঘাটায় নৌকার খ্যাতি রয়েছে শুনে তিনি এখানে নৌকা কিনতে এসেছেন।
আশাশুনি উপজেলার দুর্গাপুর থেকে আসা নৌকার কারিগর শেখ রানা আলী বলেন, সুন্দরবনে জলদস্যুতা বাড়ার কারণে এবছর নৌকার চাহিদা কমেছে। জেলেরা মাছ ধরতে সাগরে ও সুন্দরবনে গেলেই জলদস্যুরা তাদের কাছ থেকে নৌকা ছিনতাইসহ মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। আর মুক্তিপণ না দিলে তাদেরকে মারধর করে অমানসিক নির্যাতন চালায়। এসব কারণে জেলেরা খুব বেশি নৌকা কিনছে না।
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. রাসেল বলেন, উপজেলায় প্রায় এক হাজারের অধিক নৌকা শিল্পের সাথে জড়িত। নৌকা শিল্প সম্প্রসারণে সব ধরনের সরকারি অনুদান ও সহযোগিতার পাশাপাশি নৌকা তৈরির কাজে সংশিলিষ্টদের প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করা হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুন্দ্র ও কুটিটর শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপব্যবস্থাপক গৌরব দাস বলেন, নৌকা তৈরি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় পড়ে। নৌকা নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িতরা যদি মনে করে এখান থেকে সরকারি ভাবে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে তারা তাদের নির্মাণকাজ ও ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করতে চাইলে তার ব্যবস্থা করা হবে। আর সরকারি সহযোগিতা পেলে নিন্ম আয়ের অনন্ত আরও কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ