১৮ জানুয়ারি, ২০২২ ২২:০২

নিয়মের বালাই নেই রেলের অর্থ-হিসাব বিভাগে

জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতি-পদায়ন

সাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম

নিয়মের বালাই নেই রেলের অর্থ-হিসাব বিভাগে

প্রতীকী ছবি

নিয়মের বালাই নেই বাংলাদেশ রেলওয়ের অর্থ-হিসাব বিভাগে। হঠাৎ অদৃশ্য কারণে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতি-পদায়ন নিয়মেই পরিণত হয়েছে এই বিভাগে। এসব নিয়ে রেলওয়ের অর্থবিভাগে দায়িত্বরত কিছু কম্পিউটার অপারেটর বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) দপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগও দেয়া হয়েছে অনিয়ম, শৃংখলা ভঙ্গ, আইন লঙ্ঘনসহ নানা বিষয়ে। তারপরও থেমে নেই পদোন্নতি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনসহ নানা অনিয়ম। তবে ডেপুটি সিএজি’র (সিনিয়র) সঙ্গে একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি দেখা করলেও এখনও পর্যন্ত কোন ধরণের সুরাহা হয়নি। এতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান না হলে পদোন্নতি ও গ্রেডসহ বিভিন্ন বিষয়ে বঞ্চিত হতে পারেন দায়িত্বরত একাধিক কর্মচারি।

রেলওয়ের সূত্রে জানা গেছে, সরকারি একাধিক নিয়ম, আইন লঙ্ঘন করে রেলওয়ের অর্থ বিভাগে পদায়ন, পদোন্নতি প্রদান করা হচ্ছে। একই গ্রেডভুক্ত হলেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে নন-ক্যাডার জুনিয়র অডিটরদের পদোন্নতির কারণে বঞ্চিত হচ্ছে কম্পিউটার টাইপিষ্ট সহ একই গ্রেডের কর্মীরা। সম্প্রতি এ বিষয়ে একাধিক অভিযোগ জানানোর পরও নিয়ম ভেঙে পদায়ন ও পদোন্নতি থামছে না। 

সরকারি সর্বশেষ জারিকৃত নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা-২০১১ এর ৪ (২) অনুসারে, বিভিন্ন পদের সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর প্রারম্ভিক পদে নিয়মিত যোগদানের তারিখের ভিত্তিতে সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে। কিন্তু এই বিধি না মেনে বর্তমান এডিজি অর্থ দফতর পদোন্নতি ও পদায়ন করছে।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রেলের অর্থ বিভাগে কিছু বি-শৃংখলার সৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যেই রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) আনিসুর রহমান অবসরে যাবেন। তার মেয়াদকালের মধ্যেই এসব অনিয়ম ঘটেই আসছে। এতে রেল ও সিএজি দপ্তরের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করে অনেক অনিয়ম চলছে। যা কাগজেপত্রে রেকর্ড রয়েছে। এসব নিয়ে সিএজি দপ্তরে অভিযোগ দেয়া হলেও কোন ধরণের সুরাহা এখনও হয়নি। তবে দ্রুত এসবর সমাধান আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সবকিছুই নিয়মের মধ্যেই হয়েছে দাবি করে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) আনিসুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইতিমধ্যে রেলওয়ের অর্থ-হিসাব বিভাগে যেসব পদোন্নতি, বদলী করা হয়েছে, সবগুলোই নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। নিয়ম এবং বিধির বাইরে কিছুই করা হয়নি। এসব নিয়ে কোন ধরণের অভিযোগ থাকলেও লিখিত বা মৌখিকভাবেও কেউ বলেননি। কোন বিষয়ে সমস্যা হয়েছে আগে জানতে হবে, তারপর নিয়ম নাকি অনিয়ম জানা যাবে। তবে আইন বা নিয়মের বাইরে কোন ধরণের কাজ হয়নি এবং নিয়ম মেনেই করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন উর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।

রেলওয়ের একাধিক নথি পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২১ সালের ১৬ মার্চ সিএজি অফিস আদেশের মাধ্যমে এসএএস/এসআরএএস দ্বিতীয় পর্ব-২০২০ পরীক্ষায় অর্থ ও হিসাব বিভাগের ৫১ জন অডিটর, জুনিয়র অডিটর, স্টেনোগ্রাফার ও কম্পিউটার টাইপিষ্ট উত্তীর্ণ হয়। দীর্ঘ ৮ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রকাশ না করে একই বছরের অক্টোবরে শুধুমাত্র অডিটর ও জুনিয়র অডিটর থেকে ৩৫ জনকে পদোন্নতি দেয়। এ কারণে এসব কর্মীরা একটি বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট থেকে বঞ্চিত হয়। পরবর্তীতে আরো ৫ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। 

অর্থ ও হিসাব বিভাগে কম্পিউটার টাইপিষ্টরা জুনিয়র অডিটরের চেয়ে চাকরিতে জ্যেষ্ঠ হলেও উত্তীর্ণ জুনিয়র অডিটরদের পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। মূলত জুনিয়র অডিটর ও কম্পিউটার টাইপিষ্ট উভয়ই ১৬ তম গ্রেডভুক্ত কর্মচারী হলেও  পদোন্নতির ক্ষেত্রে চূড়ান্ত  জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রকাশ না করে ওই ৩৫ জনকে পদায়ন করা হয়েছে। যা নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা, ২০১১ এর ধারা ৯ এর পরিপন্থী। ২০০৭ সালে ২১ জানুয়ারি রেলওয়ের হিসাব ও অর্থ বিভাগে যোগদানকারী একজন স্টেনোগ্রাফার ১৩তম গ্রেডভুক্ত কর্মী হওয়া সত্ত্বেও তাকে অদ্যবধি পদায়ন/পদোন্নতি দেয়া হয়নি। অর্থ বিভাগের বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও ১৩তম গ্রেডের একজন কর্মীকে পদায়ন না করে ১৬তম গ্রেডভুক্ত কর্মীদের পদায়নের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। 

আরো তথ্যমতে, ২০২১ সালের ১৪ জুন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) এর কার্যালয় থেকে এসআরএএস ২য় পর্ব/২০২০ এ উত্তীর্ণ অডিটর ও জুনিয়র অডিটরদের প্রণীত জ্যেষ্ঠতা তালিকার উপর মতামত প্রদান প্রসঙ্গে একটি খসড়া তালিকা প্রণয়ন করা হয়। অর্থ বিভাগের উপ পরিচালক/অর্থ পলাশ বাকচী স্বাক্ষরিত ওই তালিকায় স্টেনোগ্রাফার ও কম্পিউটার টাইপিষ্টদের বাদ দিয়ে ৫১ জনের পরিবর্তে ৪০ জনের নাম প্রকাশ করা হয়। এ কারণে ভুক্তভোগীরা আপত্তি জানালে জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়ন পূর্বক পদোন্নতি প্রদানের লক্ষ্যে একটি ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু উক্ত কমিটির মতামত বা তালিকা প্রকাশ না করেই এসব পদোন্নতি বা পদায়ন করা হয়। এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। অতীতের একাধিক রেকর্ড করছে বদলি ও পদায়ন করে এফএএন্ডসিএওগণ। এডিজি অর্থ দফতর মনিটরিং করে মাত্র। কিন্তু প্রচলিত নিয়ম ভেঙে এডিজি অর্থ দফতর পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলি কার্যক্রম চলমান রেখেছে। এমনকি দফতর প্রধানের সুপারিশ ছাড়াই পূর্বাঞ্চলের কর্মচারীকে পশ্চিমাঞ্চলে বদলি করা হচ্ছে। এতে ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে অর্থ ও হিসাবের কর্মীরা। 

বর্তমানে অর্থ ও হিসাব বিভাগ মঞ্জুরীকৃত জনবলের ২৫ শতাংশেরও নিচে কর্মচারী নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০১২ সালের পর আর কোন নিয়োগ না হওয়ায় চরম কর্মী সংকটে ভুগছে বিভাগটি। এরপরও নিয়ম ভেঙে এ ধরণের পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নের কারণে বিভিন্ন শাখার কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা।  ২০১৮-১৯ অর্থ বছর হতে রেলওয়েতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইবাস প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এই কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দরকার বড় জনবল কাঠামো। কিন্তু সীমিত জনবল দিয়েই এসব কর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করে অর্থ হিসাব বিভাগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

আইবাস প্লাস প্লাস বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে যেয়ে ২০২০-২১ অর্থ বছরের জুন ফাইনাল হিসাব এখনো সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সমস্যার উৎপত্তি হচ্ছে এবং এসব সমস্যা সমাধান করছে সীমিত এই জনবল কাঠামো। তার মধ্যে এই ধরনের কর্মকাণ্ড কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়া ছাড়াও কর্মস্পৃহা হ্রাস করছে।


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর