শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনকে পুঁজি করে সারা দেশের মতো সাভারেও ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তিনটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ সাতটি যানবাহন। হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে সেবা প্রদানকারী হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিপণিবিতান এবং দোকানপাটে। বিশৃঙ্খলার সময় গুলিতে সাতজনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গুলিবিদ্ধসহ আহত কমপক্ষে ৫ শতাধিক।
সাভারে ভয়াবহ এমন তাণ্ডবলীলা চলার পর কারফিউকালীন সময়ে গত তিন দিন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। গত সোমবার সাভার বাস স্ট্যান্ড, পাকিজা ও থানারোড এলাকায় গিয়ে দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংসযজ্ঞ চোখে পড়ে। এসময় সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মাঝে পড়ে থাকতে দেখা যায় পুড়িয়ে দেওয়া যাত্রীবাহী ৫টি বাস, একটি মাইক্রোবাস ও একটি ট্রাক। পাকিজা এলাকায় সড়কের পাশেই সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে পুড়িয়ে দেওয়া যানবাহনগুলো। রাস্তায় পড়েছিল থানারোড এলাকায় জ্বালিয়ে দেওয়া ট্রাফিক পুলিশ বক্সের ধ্বংসাবশেষ। এ ছাড়া ভাঙচুর করা হয়েছে সাভার স্ট্যান্ডের আরও দুটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, থানারোড এলাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সব কাচ ও ভিতরে মেশিনারিজ ভাঙচুরের চিত্র। এই সেবাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে কোটি টাকার বেশি। একই এলাকার সাভার স্পেশালাইজড হাসপাতালেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া আগুন দিয়ে পোড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে সাভার স্ট্যান্ডের একটি ফুট ওভারব্রিজ। সিটি সেন্টারসহ বেশ কিছু বিপণিবিতান বন্ধ থাকায় ভাঙচুরের ক্ষত ছিল বহুতল ভবনের পুরো দেয়ালের কাচ জুড়ে। দুষ্কৃতকারীদের হামলা থেকে বাদ যায়নি প্রাণিসম্পদ অফিস কার্যালয়। ভাঙচুর চালিয়ে মারধর করা হয়েছে প্রাণিসম্পদ অফিসের এক কর্মকর্তাকে।
সাভার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার রাজু আহমেদ খালেক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর সাভারের পাকিজা এলাকায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এ সময় অতর্কিত প্রায় ৪০০ দুর্বৃত্ত দলবদ্ধ হয়ে আমাদের হাসপাতালে প্রবেশ করে। আমরা পুলিশ সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছি, এমন কথা বলে ক্যাশ কাউন্টারে ভাঙচুর শুরু করে। এ ছাড়া চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত বেশকিছু মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও অনেক কম্পিউটার ভাঙচুর করে লুট করা হয় নগদ অর্থ। সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরও জানান, যারা আমাদের প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে তাদের দেখে আন্দোলনকারী ছাত্র মনে হয়নি। তৃতীয় কোনো পক্ষ আন্দোলনের নামে হাসপাতালের মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে এমন ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে। তারা সিসিক্যামেরাও ভাঙচুর করেছে। এসব দুষ্কৃতকারীদের দ্রুত চিহ্নিত করে বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকালে সাভারের পাকিজা এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। আন্দোলনকারীরাও এসময় পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। সন্ধ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে সাভারে। থানারোড থেকে সাভার বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নেয়। এসময় এ এলাকার বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক ও প্রাইভেটকারে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়। ভাঙচুর করা হয় বেশ কিছু যানবাহনে। থানা রোড এলাকার মোড়ে অবস্থিত একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর থেকেই টানা তিন দিন শনিবার পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে শুধু সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকাতেই বিশৃঙ্খলা চলতে থাকে। পরে সরকার কারফিউ জারি করলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করে। মঙ্গলবার ও বুধবার থেকে অনেক দোকানপাট খুলেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সাভারের বাসিন্দা জিন্নাত আরা দৃষ্টি বলেন, আমি কখনো সাভারে কোনো আন্দোলনকে ঘিরে এরকম ভয়াবহতা দেখিনি। আন্দোলনকারীদের সুযোগ নিয়ে হয়তো অন্য কেউ এমন তাণ্ডব চালিয়েছে। পুলিশ বক্স আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক মার্কেটে ভাঙচুর করেছে। আন্দোলনকে পুঁজি করে যারা এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।
সাভার ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নুরুল ইসলাম বলেন, দুষ্কৃতকারীরা সাভারের প্রাণিসম্পদ অফিসে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। এ সময় ওই অফিসের এক কর্মকর্তাকেও মারধর করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সাভার পরিবহনের দুটি লোকাল বাস, দূরপাল্লার দুটি বাস, একটি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার ও একটি মাইক্রোবাস।