গত বোরো মৌসুমে অকাল বন্যার তলিয়ে যাওয়া ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই এবার পানিবন্দী হয়েছেন মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর পাড়ের লক্ষাধিক মানুষ। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে কুলাউড়া জুড়ি ও বড়লেখা উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ও বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যাবস্থা। বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান। পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে কষ্টের মধ্যে রয়েছেন দুর্গত মানুষ।
মৌলভীবাজারের হাওরের পানি বেড়ে প্রায় দু’সপ্তাহ আগে হাকালুকি হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এর মধ্যে পানি কিছুটা কমেছিলো। কিন্তু ভারি বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে গত কয়েকদিন থেকে আবারো পানি বেড়ে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কিছু বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট। ভোগান্তিতে পড়েছেন হাওর পাড়ের লক্ষাধিক মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। পৌরসভা এলাকার বিহালা, সোনাপুর, বিছরাকান্দি এলাকায় মানুষের ঘরে হাটুপানি। এছাড়া উপজেলার বরমচাল, ভাটেরা, কাদিপুর ও জয়চন্ডি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
জুড়ি উপজেলার জায়ফর নগর ও সদর ইউনিয়নের অন্তত ১০ গ্রামের মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসায় অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে। আবার কোন আশ্রয় না থাকায় আসবাবপত্র গবাদীপশু নিয়ে উচু সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন দুর্গত অনেক মানুষ।
বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওর সংলগ্ন বর্ণি, তালিমপুর, সুজানগর ও দাসেরবাজার ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকার অন্তত ৪০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী। এরমধ্যে সুজানগর ইউনিয়নের দশঘরি, রাঙ্গিনগর, বাড্ডা, ঝগড়ি, পাটনা, ভোলারকান্দি, উত্তর বাঘমারা, তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা, ইসলামপুর, কুটাউরা, বাড্ডা, নুনুয়া, পাবিজুরি, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, পশ্চিম গগড়া, পূর্বগগড়া, বড়ময়দান, গাগড়াকান্দি, তেলিমেলি, গোপালপুর, হাউদপুর, বর্ণি ইউনিয়নের পাকশাইল, সৎপুর, কাজিরবন্দ, নোওয়াগাঁও, উজিরপুর, দাসেরবাজার ইউনিয়নের চানপুর, অহিরকুঞ্জি, উত্তরবাগীরপাড়, দক্ষিণবাগীরপাড়, পানিশাইল, ধর্মদেহী, চুলারকুড়ি, কোদালী, ধলিরপাড়, নেরাকান্দি, মাইজমজুড়ি, মালিশ্রী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় দু’সপ্তাহ থেকে প্লাবিত এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ দরিদ্র মানুষ অভিযোগ করেন, তারা সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না। সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আজিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় ও দ্বিতীয়ারদেহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রায় অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন।
বড়লেখার তালিমপুর এলাকার বাসিন্দা বশির মিয়া বলেন, ‘বন্যার পানিতে ঘর অর্ধেক ডুবে গেছে। এখনও পানি কমার কোন লক্ষণ দেখছি না। আমরা বড় কষ্টে আছি। এখন পর্যন্ত কোন ত্রাণ সহায়তা পাইনি।’
কুলাউড়ার ভুকশিমইল গ্রামের ফয়জর আলী জানান, তার টিন শেডের ঘরে কোমর পানি। ঘরে বসবাস করতে না পারায় ঘরের সকল মালামাল রেখেই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছেন।’
জুড়ি উপজেলার জায়ফর নগর গ্রামের মজিদ মিয়া জানান, সপ্তাহ খানেক হলো তাদের বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। মানুষের পাশাপাশি গরু মহিষের খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। বাজার হাট করা যাচ্ছে না সময়মতো।’
রাস্তাঘাট পানির ডুবে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যাবস্থা। যোগাযোগের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত হয়েছে অস্থায়ী নৌকা ঘাট। কিন্তু নৌকা স্বল্পতার কারনে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে দুর্গত মানুষকে।
বড়লেখার তালিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শ্রীকান্ত দাস জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এখন দুর্গত মানুষের পর্যাপ্ত ত্রাণ দরকার। যা পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে মানুষের চাহিদার তুলনায় অনেক কম।’
শুধু হাকালুকি পাড়েই নয় জেলার কাউয়াদিঘী, হাইল হাওর, কেওলার হাওরসহ প্রায় প্রতিটি হাওরের এখন থৈ থৈ পানি। হাওর পাড়ের নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বি জানান, বন্যা কবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণের ভিজিএফ চাল বিতরণ করা হচ্ছে। তাছাড়া নগদ অর্থও বিতরণ করা হচ্ছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকতা আব্দুল আলীম জানান, হাকালুকি পাড়ে বন্যাকবলিত তিন উপজেলার ১২৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান সাময়িক বন্ধ রয়েছে। এছাড়া জলাবদ্ধতার কারনে রাজনগর ও সদর উপজেলার ১৮টি স্কুল বন্ধ রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চত্রবর্তী জানান, আজ (২ জুলাই) কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদ সীমার ২৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এর আগে নদীর পানি সর্বোচ্চ বিপদ সীমার ৪৫ সি.মি. উপরে ছিলো। পানি কমলেও হাওরের পানি নামতে সময় লাগবে।’
জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি না কমায় হাওর থেকে পানি বের হতে পারছে না। আক্রান্ত মানুষের মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার, স্যালাইন, নগদ অর্থ ও চাল দেয়া হয়েছে। আরো দেয়া হবে।
বিডি-প্রতিদিন/০২ জুলাই, ২০১৭/মাহবুব