আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বে শিথিলতা এবং অসাধু মাদক কারবার চক্রে জড়িয়ে পড়ায় দেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে মাদক। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে শুরু করে রাজধানীর অলিগলিতে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। শহরের বাইরে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এখন সহজলভ্য মাদক। এর বাইরে অনলাইনেও মাদকের রমরমা কারবার চলায় দেশের তরুণসমাজ নিয়ে বিচলিত বিশেষজ্ঞরা। প্রতিদিন বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। এরই মধ্যে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে মাদক কারবার ও সেবন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মাদকসংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা তিনি।
অন্যদিকে দেশে মাদকের গডফাদারদের তালিকা হালনাগাদ করে দ্রুত গ্রেফতার করতে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ক্রমাগত মাদকের চাহিদা বাড়ায় প্রতিবছর দেশ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০২৩ সালের জুনে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আংকটাড (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, শুধু মাদকের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমানে পাঁচ হাজার ৮৪১ কোটি টাকারও বেশি) পাচার হয়ে যায়।
অবৈধ মাদক কারবারের মাধ্যমে অর্থপাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম এবং এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মাদক নিয়ে গভীর কোনো গবেষণা নেই। দেশে কতসংখ্যক মাদক কারবারি ও মাদকসেবী রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ গতকাল বলেন, ‘২০১৮ সালে ৩৬ লাখ মাদকসেবীর তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। গত ছয় বছরে আর হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রধান ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ‘করোনার সময় থেকে মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্বে শিথিলতার সুযোগে গত কয়েক মাসে ২০ লাখের মতো মাদকসেবী বেড়েছে। আমাদের হিসাবে দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি মাদকসেবী রয়েছে।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘বাংলাদেশে মাদক নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। যে যার মতো তথ্য হাজির করে। মাদক নিয়ে গভীর গবেষণা হওয়া উচিত। প্রকৃত অর্থে দেশে কত মাদকসেবী রয়েছে, কারবারি রয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া দরকার।’
সূত্র মতে, মাদকসেবীদের বেশির ভাগ তরুণ। এরা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একসময় মাদক সেবনের সঙ্গে শুধু ছাত্ররা জড়িত থাকলেও বর্তমানে ছাত্রীরাও মাদক সেবন করছে। চলতি বছরের শুরুর দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অভিযান চালিয়ে মাদক সেবনরত অবস্থায় ৯ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছাত্রীও ছিলেন।
সূত্র আরো জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তল্লাশি ও নজরদারির শিথিলতায় বিভিন্ন কৌশলে মাদক কারবারিরা দেশে মাদকের চালান স্থানান্তর করছে। অ্যাম্বুল্যান্স, সবজিসহ নিত্যপণ্যের গাড়িতে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন কারবারিরা। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের ইয়াবা কারবারিরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছেন।
এদিকে মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দিলেও এখনো অস্ত্র কেনা হয়নি। তবে এরই মধ্যে ৮০ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই দেশে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাদক দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘শৃঙ্খল ভাঙার আহবান : সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’। ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২৬ জুন দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দিবসটি ঘিরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়।
মাদক কারবারে জড়িত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও মাদক কর্মকর্তারা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা গতকাল জানান, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ নানা পেশার প্রভাবশালীরা মাদকের গডফাদার হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। কিছুদিন আগে রাজধানীর বনানীতে এক অভিযানে গিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, মাদক কারবারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনেক অসাধু কর্মকর্তা জড়িত থাকায় মাদক নির্মূল করা যাচ্ছে না।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংবাদমাধ্যমে কক্সবাজারের তৎকালীন এসপি মুহাম্মদ রহমত উল্লাহর ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ার তথ্য প্রকাশিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কারা মাদক কারবারে জড়িত তাঁদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে ক্লোজ করা হয়েছে। তাঁকে গ্রেফতারও করা হবে।
তিনি বলেন, ‘যেসব কর্মকর্তা মাদকে জড়াবে তাদের বাস হবে কারাগারে।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘এক বদি গ্রেফতারের পর নতুন নতুন বদির জন্ম হচ্ছে।’
৮৫ গডফাদারসহ ১,২৩০ মাদক কারবারির তালিকা
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে ৮৫ জন গডফাদারসহ এক হাজার ২৩০ জন মাদক কারবারির পুরনো তালিকা রয়েছে। সেই তালিকায় কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদির নামও রয়েছে। তালিকাটি হালনাগাদ করার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা মাদক কারবারিদের তালিকা হালনাগাদ করার নির্দেশ পেয়েছি। সে অনুযায়ী তালিকা হালনাগাদ করছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে গডফাদার পর্যন্ত যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যারা বাহক তারা নাম জানাতে পারে না। আমরা চেষ্টা করছি যারা এখন মাদকের পেছনে রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করতে।’
অত্যাচারে অসহ্য মা-বাবা মাদকাসক্ত সন্তানকে তুলে দিচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে
২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের মুক্তগাছায় ইব্রাহিম নামের মাদকাসক্ত এক যুবককে পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁর মা-বাবা। ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে মোস্তাফিজার রহমান (২৯) নামের আরেক মাদকাসক্ত যুবককে পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁর মা-বাবা।
অন্যদিকে ২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাদকাসক্ত সন্তান শাহ পরানকে (৩৩) পুলিশের হাতে তুলে দেন জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার চর বাঙালিপাড়া এলাকার দুলাল তরফদার। ২০২১ সালের ৮ আগস্ট সন্তানের মাদক সেবনে অতিষ্ঠ হয়ে গাঁজা, হেরোইনসহ সনেট (২০) নামের এক তরুণকে পুলিশে সোপর্দ করেছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের এক পরিবার।
২০২১ সালের ৯ অক্টোবর ফরিদপুরের ভাঙ্গার পাতরাইল দিঘিরপাড় গ্রামে মাদকাসক্ত ছেলে শফিকুল ইসলাম মৃধাকে (৪১) পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁর মা।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দুই লাখ ২৮ হাজার ৭০৯ মাদকের মামলা করেছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা দুই লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৪।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ