সেই সত্তর দশকের কথা। টেবিল টেনিসের খেলা দেখতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়ামে উপচে পড়া দর্শকের সমাগম হতো। অনেকেই খেলতেন কিন্তু দৃষ্টি কাড়তেন ১০-১২ বছর বয়সি এক বালক। নাইমুল হক মুন্নার পারফরম্যান্স দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। কিশোর বয়সেই দেশের টেবিল টেনিসে আলোড়ন তুলেছিলেন মুন্না। সে কি অদ্ভুত দৃশ্য, টেবিলের চেয়ে উচ্চতায় ছোট হলেও বড় বড় খেলোয়াড়দের পরাজিত করে চমক দেখান তিনি।
যে ছেলে টেবিলের উচ্চতায় ছোট সেই কি না নামকরা খেলোয়াড়দের ধরাশায়ী করতেন। এমন অবাক করা নৈপুণ্যে তিনি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিস্ময় বালকের খ্যাতি পেয়ে যান। শুধু টিটি নয় ক্রীড়াঙ্গনে সবারই আদরের পাত্র হয়ে ওঠেন। সেই বিস্ময় বালক মুন্নাই এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। দুই বছর ধরে ডিমেনশিয়া ও পারকিনসন ভয়ংকর রোগে ভুগছেন। এ হাসপাতাল ও হাসপাতালে চিকিৎসা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। সর্বশেষ প্রফেসর আফজাল মুবিনের অধীনে ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় মুন্নাকে তার গোপীবাগের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুন্নার বড় ভাই মাসুদুল হক বুলবুল বলেন, ‘আমার ছোট ভাই দিনের পর দিন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই শরীরে উন্নতি হচ্ছে না বলে চিকিৎসকের পরামর্শে মুন্নাকে বাসায় আনা হয়েছে। বোধশক্তি একেবারে নেই, কথা বন্ধ, টিউবে খাওয়ানো হচ্ছে। বিছানায় শুয়ে প্রস্রাব-পায়খানা করছে। জানি না শেষ পর্যন্ত কী আছে কপালে।’
মুন্নার চিকিৎসা বড্ড ব্যয়বহুল। প্রতি মাসেই ১ লাখ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। শুধু পরিবারের পক্ষে চালানোটা মুশকিল হয়ে পড়েছে। এত জনপ্রিয় খেলোয়াড় অথচ একমাত্র টেবিল টেনিস খেলোয়াড় সমিতি ছাড়া মুন্নাকে সহযোগিতা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। টেবিল টেনিস ফেডারেশন শুধু খোঁজ নিচ্ছে এই যা। কথা হচ্ছে মুন্নার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ কি নেই? কত জন তো সহযোগিতা পেয়েছে ও পাচ্ছেন। ফ্ল্যাট বাড়িও পাচ্ছেন, সেখানে মুন্নার জন্য কি কিছু করা যায় না। কানাডা প্রবাসী এক খেলোয়াড়ও তো লাখ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছেন। সেখানে মুন্নার চিকিৎসার সহযোগিতা কি করা যায় না? গত সরকার আমলে কত বিত্তবান খেলোয়াড়রাও তো সহযোগিতা পেয়েছেন।
জুনিয়র বিভাগের পাঁচবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মুন্না। সিনিয়র বিভাগে কখনো শিরোপা না জিতলেও দীর্ঘদিন জাতীয় দলে আস্থার সঙ্গে খেলেছেন তিনি। থাইল্যান্ড, চীন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল কত দেশেই না সুনামের সঙ্গে জাতীয় দলে খেলেছেন। স্থানীয় লিগে স্বামীবাগ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, বিমান ও আনসারে খেলেছেন। খেলা ছাড়লেও টেবিল টেনিসের মায়া ছাড়তে পারেননি মুন্না। কোচিং ক্যারিয়ার বেছে নেন। বাংলাদেশ আনসারের দীর্ঘদিনের কোচ ছিলেন। ইংলিশ মিডিয়ামের খ্যাতনামা সাউথ ব্রিজ স্কুলের গেম টিচার ও টিটির প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। নিজে টেবিল কাঁপিয়েছেন। তার হাতে গড়া অনেকেই এখন দেশের পরিচিত খেলোয়াড়। দেশের টেবিল টেনিসের পরিচিত মুখ সেই বিস্ময় বালক মুন্না গোপীবাগের বাসায় নাকে পাইপ লাগিয়ে বিছানায় মিশে শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছেন তা কি মানা যায়? স্ত্রী ও স্কুলপড়ুয়া একমাত্র কন্যা মুন্নার পাশে থেকে শুধু চোখের পানি ফেলেই চলেছেন। এমন বিপদে কেউ কি এগিয়ে আসবেন না? ক্রীড়াঙ্গনের ঊর্ধ্বতন মহলের কি কিছু করার নেই।