শিশু থেকে তরুণী সবাই পড়েছিল লাল পেড়ে হলুদ শাড়ী। মাথায় ফুল ও কাগুজে ফুলের মালা। সবার হাত রাঙা মেহেদিতে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে গ্রামীণ গীতের আওয়াজ। আর বাতাসে পিঠা-পুলির ঘ্রাণ। সব মিলিয়ে গ্রামে ঢুকতেই পাওয়া গেল উৎসবের আমেজ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দুরে গোমস্তাপুর উপজেলার পূনর্ভবা নদী ঘেরা প্রত্যন্ত বাবুরঘোণ গ্রাম। ছোট্ট এই গ্রামেই শনিবার হয়ে গেল নবান্ন উৎসব। গ্রামের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কথা বিবেচনা করেই অগ্রাহায়ণে নয় বরং পোষ মাসেই স্কুল শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে বর্ণিল এই উৎসবের।
কলসি কাঁকে নদী থেকে পানি আনা, পানি আনতে গিয়ে নদীর তীরে সখীদের নিয়ে গীত ও নৃত্য করা, গোলা (কুঁঠি) থেকে ধান বের করা, সেই ধান প্রথমে ঢেঁকিতে ভাঙিয়ে চাল বের করা, তারপর যাঁতায় সেই চাল পিষে আটা করে বাড়ির আঙিনায় দলবদ্ধ হয়ে বসে পিঠা-পুলি বানানো আর গীত পরিবেশন -এ সবই ছিল ওই নবান্নের আয়োজনে।
গত আট বছর ধরে নিয়মিতই হয়ে আসছে এই উৎসব। বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের সময় থেকেই এই উৎসবের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই সময় বাড়ি বাড়ি থেকে ধান সংগ্রহ করা হয় উৎসবের জন্য। গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারই উৎসবে অংশ নিতে ধান দেন। সেই ধান থেকেই মূলত বানানো হয় পিঠা-পুলি। আর এই উৎসবের তত্ত্বাবধান করেন ওই গ্রামের স্কুল শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। তাকে সহযোগিতা করেন তার বোন শামীমা বেগম।
শনিবার সকাল থেকেই বাবুরঘোণ গ্রামে ছিল উৎসবের আমেজ। সকাল থেকেই মমতাজ বেগমের বাড়িতে জড়ো হন গ্রামের তরুণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারীরা। বাড়ির আঙিনায় গোল হয়ে বসে তারা বিভিন্ন ধরণের পিঠা বানান। পিঠা বানাতে বানাতে সমস্বরে গান পিঠা বানানোর গান। তেলপিঠা, তিলপিঠা, ভাপাপিঠা, পুলিপিঠা, দুধপিঠাসহ বাহারী নামের পিঠা বানানো হয়। বাড়িতে যখন ওই আয়োজন চলছে তখন তরুণীরা দলবেধে নদীতে যায় পানি আনতে। সেখানেও গাওয়া হয় পানি আনার গান। দেখানো হয় নাচও। এরপর প্রতীকিভাবে দেখানো হয় ঢেঁকিতে ধান ভানা ও যাতায় আটা পেষা। শেষে বানানো পিঠা ভাগ করে দেয়া হয় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে।
বিকেলে ওই গ্রামের একটি মাঠে অনুষ্ঠিত হয় শিশুদের নিয়ে নাচ ও গানের। গ্রামের বিভিন্ন বয়সের মানুষ ওই অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
উৎসবে অংশ নেয়া তরুণী নাঈমা, লিজা, ও সিফা খাতুনসহ অন্যরা জানান, এই দিনটিকে ঘিরে রীতিমত উৎসবের আমেজ বয়ে যায় গোটা গ্রামের। এই দিনে তারা অনেক মজা করেন। বিশেষ করে প্রত্যেকটা কাজের সঙ্গে যে আলাদা আলাদ গীত গাওয়া হয়, সেটা খুবই উপভোগ্য একটা বিষয়। গ্রামের শিশু ও তরুণীরা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।
ওই গ্রামে বাড়ি নয়, তবুও উৎসবে অংশ নিয়েছেন পাশের গ্রামের সুফিয়া। তিনি জানান, আসলে প্রাণের টানেই এই উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন তিনি। যদিও তিনি আমন্ত্রিত অতিথি, কিন্তু এই উৎসবটা তিনি দারুণভাবে উপভোগ করেন। অজপাড়াগাঁয়ে এমন একটি নবান্ন উৎসবে যোগ দিতে পেরে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত বলেও মন্তব্য করেন।
সাত বছর আগে যখন মমতাজ বেগম ও শামীমা বেগম এই উৎসব উদযাপন শুরু করেন তখন খুব একটা সহজভাবে নেয়নি গ্রামের মানুষ। ধর্মীয় অনুশাসনের অপব্যাখ্যা দিয়ে এই উৎসবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টাও করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সেটা মেনে নেননি মমতাজ ও শামীমা। উৎসবের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা এভাবেই বর্ণনা করেন মমতাজ বেগম। মমতাজ বেগম জানান, এ সব গ্রামীণ সংস্কৃতির চর্চা হলে অপরাধ প্রবণতা কমবে। নারীরা তাদের ঘরে মর্যাদা পাবে। দেশের গ্রামে গ্রামে এই সংস্কৃতি চর্চার প্রবণতা শুরু হোক এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন