সোমবার, ২২ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

সংগীত ভুবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র ফেরদৌসী রহমান

সংগীত ভুবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র ফেরদৌসী রহমান

প্রখ্যাত পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা চিরসবুজ গানের পাখি ফেরদৌসী রহমান। একজন সংগীতশিল্পী এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের সংগীত শিক্ষক হিসেবে যিনি সবার কাছে এক মুগ্ধতার নাম। কণ্ঠে কিংবা চেহারায় আগে যেমনটি ছিলেন এখনো ঠিক তেমনটিই রয়েছেন। এই প্রিয় ব্যক্তিত্বের জীবনের নানা জানা-অজানা বিষয় নিয়ে আয়োজন সাজিয়েছেন- পান্থ আফজাল

 

মিষ্টি হাসির কন্যার জন্ম ও বংশ পরিচয়

১৯৪১ সালের ২৮ জুন পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে (ব্রিটিশ ইন্ডিয়া) তাঁর জন্ম। বাবা প্রখ্যাত পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তাঁর দুই ভাই। এক ভাই সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। অন্য ভাই বিচারপতি মুস্তফা কামাল ২০১৫ সালে পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। সংগীতশিল্পী নাশিদ কামালের চাচি হলেন ফেরদৌসী রহমান। তিনি সংগীতশিল্পী সামিরা আব্বাসী ও শারমিনী আব্বাসীরও চাচি।

 

ফেরদৌসী বেগম থেকে ফেরদৌসী রহমান

বিয়ের পরই ফেরদৌসী বেগম থেকে তিনি হলেন ফেরদৌসী রহমান। ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন রেজাউর রহমানকে। তিনি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর ২টি ছেলে রুবাইয়াত ও রাজিন। তারা আজ প্রতিষ্ঠিত। সময় পেলে তিনি বিদেশে ছেলেদের কাছে বেড়াতে যান।

 

বাংলা গানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম

বাংলা গানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম বলা হয় তাঁকে। বাংলা গানের বিভিন্ন ধারার অনেক কিছুর শুরু তাঁর হাতে। পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, আধুনিক এবং প্লেব্যাক সব ধরনের গানই তিনি করেছেন।  বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী চিরসবুজ এই  কণ্ঠশিল্পী। ১৯৪৮ সালে প্রথম রেডিওতে গান করেন। ‘খেলাঘর’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে সাত বছর। তখন তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন এইচ এম ভি থেকে। ১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ নামের চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম প্লে-ব্যাক করেন। এই ছবি মুক্তির আগে অবশ্য মুক্তি পায় ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিটি। ১৯৬০ সালে ফেরদৌসী রহমান ইউনেস্কো ফেলোশিপ পেয়ে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে ৬ মাসের সংগীতের ওপর স্টাফ নোটেশন কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনিই গান করেন। ‘ওই যে আকাশ নীল হলো আজ সে শুধু তোমার প্রেম’-গানটি ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম গান। এটা একটা বিরল রেকর্ডও বটে। প্রথম কোনো মহিলা সংগীত পরিচালক হিসেবে রবীণ ঘোষের সঙ্গে ‘রাজধানীর বুকে’ নামক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন তিনি। বিটিভিতে বাচ্চাদের হাতেকলমে গান শেখার আসর ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান শুরু তার হাত দিয়েই। যে অনুষ্ঠানটি সারা বাংলাদেশে তুমুল গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। অন্যদিকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে সাংস্কৃতিক টিম দেশের বাইরে যায়, তার নেতৃত্বও দেন তিনি।

 

বাবার মতো একধারায় আটকে থাকেননি

প্রখ্যাত পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা ফেরদৌসী রহমান। পিতা বিখ্যাত হয়েছিলেন একধারার গানে। অর্থাৎ পল্লীগীতি গেয়ে। তিনি বেছে বেছে গান করতেন। ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেও তিনি চেষ্টা করতেন ভালোটা-সেরাটা দিতে। ফেরদৌসী রহমান পল্লীগীতি ছাড়াও রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান ও চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকসহ সব ধরনের গানই তিনি করেছেন। বাংলা ছাড়া তিনি উর্দু, ফারসি, আরবি, চীনা, জাপানি, রুশ, জার্মানসহ আরও বেশ কিছু ভাষায় গান গেয়েছেন। সংগীত পরিচালনাও করেছেন।

 

সেই খালামণির ‘এসো গান শিখি’

বিটিভির জনপ্রিয় শিশুতোষ অনুষ্ঠান ‘এসো গান শিখি’ দিয়ে সবার কাছে ‘খালামণি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন ফেরদৌসী রহমান। সেই চিরচেনা মিষ্টি হাসি! এ দেশের কয়েকটি প্রজন্মের শৈশবস্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শিক্ষামূলক শিশুতোষ অনুষ্ঠানটির সঙ্গে। পাপেট মিঠু-মন্টি, গানের খালামণি-কত কি-ই না এই একটি অনুষ্ঠান থেকে পেয়েছে দর্শকরা! বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫৫ বছর পূর্তি হয়েছে। সেই সঙ্গে জনপ্রিয় এই শিশুতোষ অনুষ্ঠানও পেরিয়েছে ৫৫ বছর। দীর্ঘ সময় ধরে পাক্ষিকভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়ে আসছে ‘এসো গান শিখি’। পুরনো সে চরিত্রগুলোই নতুন সময়ে নতুনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। মাঝে কিছু সময় প্রচার বিরতিতে ছিল। ‘গানের খালামণি’ হয়ে সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানকে দেখা যায় এই অনুষ্ঠানটিতে। তাঁর সঙ্গে থাকে পাপেট চরিত্র মিঠু ও মন্টি।

 

গানের জগতে তার রেকর্ড

’৬০ ও ৭০-এর দশকের বহু চলচ্চিত্রে তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর প্লেব্যাক করা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৫০-এর কাছাকাছি। ৩টি লং প্লেসহ প্রায় ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড এবং দেড় ডজনের বেশি গানের ক্যাসেট বের হয়েছে তাঁর। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার গানের রেকর্ড হয়েছে তাঁর। তিনি ১৯৫৯ সালে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যেসব গান করেছেন তার সব আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। তার সময়ের গানগুলোর আবেদন কোনোদিনও ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। এমনকি এ প্রজন্মের শিল্পীরাও তার গাওয়া সেদিনের গান আজও নতুন করে গাইছেন।

 

প্রিয় যেসব গান মন টানে

তাঁর গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, ‘মনে যে লাগে এতো রঙ’, ‘নিশি জাগা চাঁদ’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি’, ‘হার কালা করলাম রে’, ‘গহিন গাঙের নাইয়া’ ও ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝে সই’ ‘কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু’, ‘ও কি বন্ধু কাজল ভ্রমরা’, ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে’। এ ছাড়াও তার গাওয়া সব গানই শ্রোতাপ্রিয়। ফেরদৌসী রহমানের শিল্পী জীবনের একটি বিরাট সৌভাগ্য তিনি এ দেশের অনেক সুরকারের সুরে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আবদুল আহাদের সুরে আধুনিক গান সবচেয়ে বেশি তিনিই গেয়েছেন।

 

৭৯ ছুঁই ছুঁই অদম্য কিশোরী

এ মাসের ২৮ জুন তাঁর জন্মদিন। ৭৯-তে পা দেবেন তিনি।  এখনো ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান নিয়মিত করছেন। এর বাইরে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্বাসউদ্দীন সংগীত একাডেমির পেছনে সময় দিচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া গানগুলো এখন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও আবারও গাইতে শুরু করেছেন। এটিকে আরও বড় করার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। নতুন শিল্পীদের তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন।

 

আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনায়

মোটাসোঁটা একটা বই বের করার ইচ্ছে রয়েছে ফেরদৌসী রহমানের। কোচবিহার আর বলরামপুরে ফেলে আসা শৈশবের গল্প নিয়ে লিখবেন আত্মজীবনী। তিনি বলেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমানোর গল্প। বাবা আব্বাসউদ্দীনের কোলে বসে গান শোনার গল্প। গান শোনা আর গান গাওয়া শুরু করার গল্প। টিভি-রেডিও, দেশ-বিদেশে কত ঘটনাই তো আছে এই ছোট্ট জীবনে। আদ্যোপান্ত জীবনটা আমার তুলে আনার ইচ্ছা সেই বইয়ে।’

 

পুরস্কার ও সম্মাননা

দীর্ঘ জীবনে সংগীত ভুবনে অবদান রাখার জন্য অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তাঁর অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে আছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩ সাল)। ১৯৬৫ সালে সর্বকনিষ্ঠ সংগীতশিল্পী হিসেবে পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার। এরপর একে একে হাতে উঠে এসেছে সেরা টিভিশিল্পী, সংগীত পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার, একুশে পদক, নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক থেকে শুরু করে অগণন পুরস্কার ও স্বর্ণপদক। অসুস্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৫ নিতে পারেননি তিনি। তবে সেই পুরস্কারের একটা বিশেষত্ব ছিল। সিনেমার গানে অবদানের জন্য এই পুরস্কারটা দেওয়া হয়েছিল। এই বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমার জন্য অনেক সম্মানের। আগে বহু পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু এটার অনুভূতি অন্যরকম। সম্মাননা পেলে ভালোই লাগে। মনে হয়, দেশের জন্য তো কিছু করেছি, তাই এভাবে আমাকে সম্মাননা জানাচ্ছে। আমি বাবার কোলে বসে গান শুনতাম, শিখতাম। এভাবেই পথচলা শুরু। তবে বাবা ছাড়াও আমাকে সংগীতের শিক্ষা দিয়েছেন মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরাইশী, কাদের জামেরী, নাজাকাত আলী খানের মতো নামজাদা ওস্তাদরা। সেই ছোটবেলা থেকে গান গেয়ে এসেছি মনের আনন্দে। প্রাপ্তির আশায় কিছু করিনি।

সর্বশেষ খবর