বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা অনেক তরুণকে দেখি, যারা সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন। তারা শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখে, সমাজতন্ত্রের দর্শনে বিশ্বাস করে, ধর্মীয় ন্যায়ের কথা বলে, আর্থসামাজিক সুষম বণ্টনের পক্ষে কথা বলে। এই তরুণদের বক্তৃতায়, পোস্টারে, প্রবন্ধে, আন্দোলনে আমরা আশাবাদী হই- ভাবতে থাকি, ভবিষ্যতে সমাজকে তারা বদলে দেবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই একই তরুণ যখন চাকরিতে অথবা রাজনীতিতে প্রবেশ করে, বিশেষ করে পদমর্যাদা পেলে তখন তাদের অধিকাংশ নিজেরাই হয়ে ওঠে সেই অন্যায়ের প্রতিনিধি। যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একসময় কথা বলেছিল তারাই দুর্নীতির অংশ হয়ে ওঠে, ঘুষের লেনদেনকে প্রশ্রয় দেয়, ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। শুধু তা-ই নয়, নিজের সুবিধার জন্য অন্যায়কে জায়েজ করে এবং ধীরে ধীরে নৈতিকতা ও আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়।
এই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের কারণ কী?
তরুণদের একাংশ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে আদর্শ, নৈতিকতা আর প্রতিবাদের বার্তা বহন করে, কর্মজীবনে প্রবেশের পর তাদের আচরণে ঠিক তার উল্টো চিত্র দেখা যায়। প্রশ্ন উঠছে, এই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় কেন ঘটে? একজন আদর্শবান তরুণ কিছু বছরের ব্যবধানে কীভাবে এমন দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে? এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বহুস্তরবিশিষ্ট অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রভাব, যেগুলো ব্যক্তির চেতনা জগতে গভীর শিকড় বিস্তার করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি মূল কারণ আলোচনার দাবি রাখে।
পচন ধরা সিস্টেমের কাছে আত্মসমর্পণ : বাংলাদেশের অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমন এক ‘দুর্নীতিবান্ধব’ ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়, যেখানে সততা একটি ব্যতিক্রমী গুণ বলে বিবেচিত হয়। নতুন একজন তরুণ কর্মকর্তা যখন একটি অফিসে যোগ দেন, প্রথমেই তিনি দেখেন প্রায় সবাই নিয়ম ভাঙছে, কমিশন নিচ্ছে, ঘুষ দিচ্ছে-নিচ্ছে, কোনো কাজ নৈতিকতার ভিত্তিতে হচ্ছে না। প্রথমে তিনি হয়তো প্রতিবাদ করেন, মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়-একাকিত্ব বাড়ে, সহকর্মীদের কটূক্তি সহ্য করতে হয়। ধীরে ধীরে মানসিক ক্লান্তি ও একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি নিজেই ‘সিস্টেম’-এর সঙ্গে মানিয়ে নেন। একপ্রকার ‘নৈতিক আত্মসমর্পণ’, যেখানে ব্যক্তি নিজের চেতনার সঙ্গে আপস করে। এ পরিস্থিতিকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী বলেন ‘সিস্টেমেটিক পলিউশন’, যেখানে ব্যক্তি নয়, বরং পুরো কাঠামোই অন্যায়কে স্বাভাবিক বানিয়ে তোলে। ভালো থাকাটাই যখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখন অনেকেই ‘ভালো’ থাকার চেষ্টাটাই বাদ দেয়।
বঞ্চনার ক্ষোভ, লোভের বিস্তার : শৈশব বা কৈশোরে দারিদ্র্য, উপেক্ষা অথবা অপূর্ণতা যারা অনুভব করে, তাদের এক শ্রেণি মনে করে, ‘টাকাই সম্মান, টাকাই মুক্তি।’ এ বঞ্চনা থেকে জন্ম নেয় প্রতিরোধমূলক প্রতিশোধপরায়ণতা, যার মূলমন্ত্র ‘জীবনে যা পাইনি, তা এখন যে কোনো মূল্যে অর্জন করতে হবে।’ এমন মানুষের কাছে টাকা কোনো উপকরণ নয়, বরং হয়ে ওঠে জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। তারা সৎ বা অসৎ পন্থা নিয়ে মাথা ঘামায় না, শুধু ভাবে, কে কত কম সময়ে কত বেশি অর্থ কামাতে পারছে। এ অর্থলোভ একসময় নৈতিকতা পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দেয়।
পরিবার ও নিকটজনের প্ররোচনা : কোনো কোনো পরিবার-পরিমণ্ডলেই দুর্নীতিকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হয়। ‘সরকারি চাকরি পেয়েছ, এখন কিছু করো’, ‘অমুকের ছেলেও তো প্রাইভেট কার কিনেছে’, এমন খোঁচা-ভরা কথা তরুণের মনে চাপ তৈরি করে। অনেকে স্ত্রী বা শ্বশুরবাড়ির অতিরিক্ত প্রত্যাশার শিকার হয়। এ পারিবারিক সংস্কৃতি আসলে দুর্নীতিকে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি দেয়। ফলে একজন তরুণ কর্মকর্তা যখন কোনো অবৈধ আয়ে লিপ্ত হয়, তখন সেটি কেবল তার ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, বরং পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক চাপে গঠিত এক জটিল সামাজিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।
সফলতার বিকৃত সংজ্ঞা এবং সামাজিক প্রতিযোগিতা : আজকের সমাজে ‘সফল’ হওয়া মানে হলো বেশি উপার্জন, বিদেশ ভ্রমণ, বড় ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি। এ সামাজিক মানদণ্ড একটি বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে- যেখানে কেউ যদি নীতিগত কারণে পিছিয়ে থাকে, তাকে ব্যর্থ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। সততা, আত্মত্যাগ, সেবাবোধ, মানবিকতা- এই গুণগুলো আজ অনেকের কাছে ‘ভদ্রলোকের বিলাসিতা’। এর পরিবর্তে দ্রুত অর্জন, ফাস্ট লাইফস্টাইল এবং অহমিকাপূর্ণ প্রতিপত্তিকেই সমাজ সফলতা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ চেতনাই তরুণদের মনে গেঁথে দেয় যে, ‘টাকাই এখন সব, আর সেটি কোন পথে আসছে, তা বড় কথা নয়।’ ফলাফল- নৈতিকতা পরিত্যক্ত হয়, আত্মমর্যাদাকে গলা টিপে ধরা হয়, আর মূল্যবোধ ব্যর্থ প্রতিযোগিতার বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
এ স্তরগুলো আমাদের বুঝিয়ে দেয়, একজন আদর্শবান তরুণ হঠাৎ করে দুর্নীতিবাজ হয়ে যায় না-তা ধীরে ধীরে, বহু স্তর পেরিয়ে ঘটে। কাঠামোগত পচন, সামাজিক চাপ, পারিবারিক প্ররোচনা এবং ব্যক্তিগত মানসিক সংকট একত্র হয়ে তৈরি করে এক জটিল মানসিক দ্বন্দ্ব। তাই শুধু ব্যক্তি নয়, বরং আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও এ আদর্শচ্যুতি প্রতিরোধের দায়িত্ব নিতে হবে।
দুর্নীতিবাজদের পরিণতি-ধন আছে, শান্তি নেই : অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জন করে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, বাহ্যিকভাবে তাদের সফল মনে হয়। কিন্তু গভীরে গিয়ে দেখা যাবে, তাদের জীবনে প্রকৃত শান্তি, সুখ বা সম্মান অনুপস্থিত। তাদের অনেকেই সন্তানদের হাতে নিগৃহীত হয়, পারিবারিক অশান্তিতে ভোগে, মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। সমাজে তারা বাহ্যিকভাবে ভদ্রলোক হলেও ভিতরে ভিতরে একাকিত্বে দগ্ধ হয়। তাদের অর্জিত সম্পদ অনেক সময় দুই প্রজন্ম পার না হতেই ভেসে যায়।
এগুলোই হলো এক ধরনের প্রাকৃতিক শাস্তি, ন্যাচারাল পানিশমেন্ট-যা কোনো আদালত দেন না, কিন্তু জীবনের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা দিয়ে তা ঘটে যায়। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে সবকিছুরই একটা ভারসাম্য রাখেন। যে মানুষ অন্যের হক মেরে খায়, মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করে সম্পদ গড়ে তোলে, সে কোনো না কোনোভাবে অপমান, অপদস্থ কিংবা দুর্ভাগ্যের শিকার হয়, এটি ইতিহাস ও বাস্তবতা বারবার প্রমাণ করেছে।
করণীয়-আদর্শের শিকড়কে পুনরুজ্জীবিত করা : নৈতিক অবক্ষয়ের যে ভয়াবহ চিত্র আমাদের সমাজে প্রতিদিন প্রতিফলিত হচ্ছে, তা থেকে মুক্তি পেতে কেবল আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়। কারণ এ সংকটের শিকড় ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের গভীরে প্রোথিত। প্রয়োজন আদর্শচর্চার পুনর্জাগরণ, যা শুরু করতে হবে ঘরের ভিতর থেকেই।
প্রথম পাঠটি হওয়া উচিত, পরিবারে শিশুর মনে ছোটবেলা থেকেই গেঁথে দিতে হবে- সাফল্য মানে কেবল আর্থিক প্রাচুর্য নয়, বরং আত্মমর্যাদা, মানবিকতা ও সৎ জীবনের সাহসিকতা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, কেবল পাঠ্যবইয়ে নয়, চর্চায়, আচরণে ও অনুশীলনে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছে একজন শিক্ষার্থী যেন সমাজ, রাষ্ট্র ও নিজের প্রতি দায়িত্ববোধ উপলব্ধি করতে শেখে। সেখানে তার ভিতর তৈরি করতে হবে আত্মসমালোচনার দক্ষতা, নৈতিক স্থিরতা ও মানবিক চেতনার গভীর ভিত। তাকে বোঝাতে হবে, প্রকৃত জয় তখনই, যখন সে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার ভিতর থেকেও সৎ থাকতে পারে, চাপের মুখেও নিজের বিবেককে বিকিয়ে দেয় না।
আজকের সমাজে টাকার প্রতি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক আসক্তি তৈরি হয়েছে, যা ক্রমে আর্থিক লোভকে এক ধরনের মানসিক রোগে রূপান্তরিত করছে। এ রোগে আক্রান্ত মানুষমাত্রই আত্মতৃপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকে। তাদের অর্জিত অর্থ ও সম্পদ ব্যক্তিজীবনে শান্তি তো আনে না, বরং সম্পর্কের টানাপোড়েন, মানসিক চাপ ও অস্তিত্বের অনিশ্চয়তাই জন্ম দেয়। তথ্য বলছে, দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে মানুষ কেবল নৈতিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও অস্থির থাকে। ভোগের সীমাহীন প্রতিযোগিতা মানুষকে একা করে তোলে, সন্দেহপ্রবণ করে তোলে, আত্মিক শান্তির দরজা বন্ধ করে দেয়। তাই অবৈধ অর্থ বা ক্ষমতার মোহ থেকে বেরিয়ে আসাই স্থায়ী কল্যাণের পথ।
আত্মবিশ্লেষণের সময় এখন : এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একটি জাতীয় আত্মবিশ্লেষণ। আমাদের দেখতে হবে, কেন বারবার আদর্শবান তরুণরা ক্ষমতার লোভে আদর্শ বিসর্জন দিচ্ছে? কেন রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সৎ মানুষের সংখ্যা কমে আসছে? এ সংকট শুধু ভবিষ্যতের নয়, বরং বর্তমানেরও জরুরি প্রশ্ন। একটি জাতির ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয় তখনই, যখন তার তরুণরা আদর্শচ্যুত হয় এবং সেই চেতনার জায়গা দখল করে আত্মকেন্দ্রিকতা, লোভ ও সুবিধাবাদ। রাষ্ট্র তখনই দুর্বল হয়, যখন সিস্টেম নামক এক অদৃশ্য দানব তার সন্তানদের বিবেক গিলে ফেলে। এখনই সময় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার। সময় এসেছে নৈতিকতার আলোকে মানুষ ও সমাজ গড়ার, যেখানে দায়িত্ব থাকবে, কিন্তু লোভ থাকবে না; প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু অন্যায় থাকবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক