আবারও জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত ‘যশোরের দুঃখ’ হিসেবে পরিচিত ভবদহ এলাকা। ইতোমধ্যে জেলার অভয়নগর ও মণিরামপুর উপজেলার ৪৫টিরও বেশি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। আটকে পড়েছে মানুষ। গত এপ্রিলে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা একসঙ্গে ভবদহ এলাকা পরিদর্শন করেন। তাঁদের তৎপরতা ও প্রতিশ্রুতিতে ভবদহ এলাকার মানুষের মনে আশার সঞ্চারও হয়। পানিসম্পদ উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছিলেন, অভয়নগরে দ্রুত আমডাঙ্গা খাল সংস্কার ও চওড়া করা হবে, যাতে ভবদহ এলাকার বড় একটি অংশের পানি আপাতত ভৈরব নদে নেমে যেতে পারে। এর পাশাপাশি জলাবদ্ধতা সমস্যার যাতে স্থায়ী সমাধান হয়, সেদিকেই সরকার হাঁটবে। এই ঘোষণার পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করে। আমডাঙ্গা খাল চওড়া ও সংস্কারের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। এ নিয়ে বাধে ঝামেলা। তৈরি হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। শেষ পর্যন্ত এ কাজ আর এগোয়নি। যথারীতি এবারের বর্ষায় আবারও পানিতে আটকা ভবদহের মানুষ। এর আগের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময়ে যতবারই ভবদহ জলাবদ্ধতা সমস্যার নিরসনে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার সবই ব্যর্থ হয়েছিল মূলত লুটপাটের কারণে। অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতায় এলাকার মানুষ আশান্বিত হয়েছিল, এবার প্রকল্প হলে অন্তত লুটপাট হবে না, সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তারা সে আশাও হারিয়ে ফেলছে।
চলতি মাসের শুরুতে একটি চীনা বিশেষজ্ঞ দল ভবদহ এলাকা পরিদর্শন করে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজবে সরকার। তবে ‘বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বিষয়ে এলাকার মানুষের ভীতি রয়েছে। কারণ ভবদহ সমস্যা শুরুর পেছনেও ছিল বিদেশি বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয়রা বলছেন, এসব বিশেষজ্ঞ তাদের দেশের নদী ও নদীর পানির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। তাদের দেশের নদী ও নদীর পানির গতিপ্রকৃতি আমাদের দেশের নদী ও নদীর পানির গতিপ্রকৃতির চেয়ে আলাদা। ফলে এসব বিদেশি বিশেষজ্ঞ তাদের দেশের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের দেশের নদী ও নদীর পানি নিয়ে পরামর্শ দিলে তার ফলাফল সঠিক হয় না। যার দৃষ্টান্ত ভবদহ সমস্যা।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪-৫৫ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়। এরপর জাতিসংঘের সুপারিশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যা সমাধানে ক্রুগ মিশন গঠন করা হয়। এই মিশন সরকারের কাছে একটি সুপারিশ দেয়। এরপর ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদা গঠন হওয়ার পর বন্যানিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই ওয়াপদাকে। তারা বন্যানিয়ন্ত্রণ ও লবণাক্ততা নিরসনে ‘উপকূলীয় বাঁধ’ নির্মাণের প্রকল্প নেয়, যা ছিল তখনকার দুই খণ্ড পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এই প্রকল্পেরই অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালে অভয়নগর উপজেলার ভবদহ নামক স্থানে হরি নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীর উভয় পাশে মোট ৩৬টি স্লুইস গেট ও পোল্ডার নির্মাণ করা হয়। নদীর সঙ্গে সব বিলের সংযোগস্থলেও দেওয়া হয় স্লুইস গেট।
এই প্রকল্পের ফলে বিল ও ফসলের খেতে লোনাপানির প্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব হয়। এর ফলে এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ফসল উৎপাদন হতে থাকে। বছরে আউশ, আমন ও বোরো তিনটি ফসল হতো। এলাকার মানুষের মাঝে স্বাচ্ছন্দ্য আসে। কিন্তু এ প্রকল্পটি যে টেকসই ছিল না, এক যুগ যেতে না যেতেই তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। জোয়ারের পানির সঙ্গে আসা বিপুল পরিমাণ পলি বিলে ঢুকতে না পেরে নদীবক্ষেই জমা হতে থাকে। ওদিকে ফারাক্কার কারণে নদীর উজান থেকে পানির চাপও কমতে থাকে। পলি জমে জমে দ্রুত উঁচু হতে থাকে নদীর তলদেশ। কমতে থাকে নদীর পানিনিষ্কাশন ক্ষমতা। ব্যাহত হয় প্রাকৃতিক ভূমি গঠন প্রক্রিয়া। বৃষ্টি হলেই নদী, বিল ভরাট হয়ে আশপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত করে। আর একবার গ্রামগুলো প্লাবিত হলে সে পানি আর বেরোনোর কোনো পথ পায় না। সৃষ্টি হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা।
সত্তরের দশক থেকেই এ সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। তবে আশির দশকের শুরুতে এসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। ১৯৮৮ সালে যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর উপজেলা এবং খুলনার ফুলতলা, ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলার বিশাল অংশ। ক্ষতিগ্রস্ত হন ১০ লক্ষাধিক মানুষ।
এরপর ক্ষতিগ্রস্তদের আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সরকার আমলে ভবদহ জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সমস্যা কেবল জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। এর আগে স্থানীয়দের উদ্ভাবিত প্রকল্প টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বা জোয়ারাধার প্রকল্প চালু হলে জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু দুটি বিলে এ প্রকল্প করার পথে নানা ষড়যন্ত্রে তা শেষ পর্যন্ত আর চলতে পারেনি। ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হোক। কিন্তু এর পাশাপাশি জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত এলাকাবাসীর কথাও যেন গুরুত্বসহকারে শোনা হয়, এ দাবি দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগীরা করে আসছেন।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী