কুমিল্লার মুরাদনগরে যে নারকীয় বীভৎস ঘটনা ঘটেছে তা গোটা জাতিকে স্তব্ধ করেছে। কুমিল্লার এ ঘটনাটি আমাদের সবার সামনে নতুন একটি প্রশ্ন এনেছে, তা হলো এ দেশ কি আমাদের সবার? দুর্ভাগ্যজনক হলো এ ঘটনার পর অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, এদের পরিচয় একটাই তা হলো এরা দুর্বৃত্ত। সমাজের জন্য বিপজ্জনক।
আমরা নতুন বাংলাদেশ কেমন চেয়েছিলাম? জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা বৈষম্যমুক্ত সমঅধিকারের একটি বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি? ১১ মাস পেছনে ফিরে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমাদের বুকভর্তি হতাশা, বেদনা এবং আশাহতের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। মুরাদনগরের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সারা দেশে গত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে ভয়াবহ অবনতি, কিছু মানুষের মধ্যে যে মবসন্ত্রাসের উন্মত্ততা তারই একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সেখান থেকে আমাদের মুক্তির পথ কী? এর আগে শিশু আছিয়ার ঘটনা সারা দেশকে স্তম্ভিত করেছিল। আছিয়ার ঘটনার পর সরকার দ্রুত সে ঘটনার তদন্ত করে। বিচার সম্পন্ন করে। কিন্তু একটি দেশে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকে, দেশ যদি নীতি এবং কাঠামোর ওপর না পরিচালিত হয়, আইনের শাসন যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে একটি বিচার এ ধরনের জঘন্য ঘটনা বন্ধ করতে পারে না। গত ১১ মাসে এটি প্রমাণিত সত্য। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্থানে মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। এ মব সন্ত্রাসকে আবার কোনো কোনো মহল জায়েজ করার চেষ্টা করছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, সরকারের আবেদন, নিবেদন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার পরও মব সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না। বরং কোনো কোনো মহল এ মব সন্ত্রাসকে উসকে দিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। আমরা যদি এ ধরনের মব সন্ত্রাস বন্ধ না করতে পারি, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এ উন্মত্ততা যদি থামাতে না পারি, তাহলে কখনই আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ পাব না।
এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, জুলাই বিপ্লবে এ দেশের নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক বিস্তৃত। আমাদের নারীরা তাদের ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল স্বৈরাচারের পতনের জন্য। ছাত্র-তরুণদের আন্দোলনের সঙ্গে যখন গৃহবধূ নারী, শিশুকে কোলে নিয়ে আসা মা কিংবা নানা পেশার কর্মজীবী নারীরা যখন যুক্ত হয়েছিল, তখন এ আন্দোলন সর্বজনীন রূপ পেয়েছিল। সবার আশা ছিল এ আন্দোলনের সর্বজনীনতাই প্রতিফলিত হবে নতুন বাংলাদেশে। বাংলাদেশে নারীরা তাদের অধিকার পাবে, মর্যাদাপূর্ণ জীবন পাবে, নারীদের কেউ হেয় প্রতিপন্ন করবে না। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে। শুধু নারী নয়, সব মানুষকে সম্মান এবং মর্যাদা দেওয়া হবে। কিন্তু গত ১১ মাসে নারীদের জন্য অনিরাপদ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন স্থানে নারীদের হয়রানি করা হচ্ছে, নারীদের অপদস্তের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। পোশাকের কারণে নারীকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। নারীকে হতে হচ্ছে অপমানিত, লাঞ্ছিত। বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার বিপরীতে সরকারের যা করণীয় ছিল, সরকার দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা করতে পারেনি। এ সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এটি একটি অন্তর্র্বর্তী সরকার। তার বিভিন্ন রকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর এ সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকার কিছুতেই যেন সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে হাঁটতে পারছে না।
নারীরাই শুধু অনিরাপদ নয়, এ দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হলো আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ। নারীদের চেয়েও অসহায় এখন ব্যবসায়ী সমাজ। বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য রীতিমতো স্থবির। শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন শিল্প, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট হয়, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এগুলোর একটারও বিচার হয়নি। এরপর শুরু হয় মামলাবাণিজ্য। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়। ভৌতিক হত্যা মামলার আসামি বহু ব্যবসায়ী। এ ধরনের মামলা ব্যবসায়ীদের কেবল বিব্রতই করেনি, ভীতি ও আতঙ্কিতও করেছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ওপর হামলা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, তার সঙ্গে হত্যা মামলার ঘটনা যুক্ত হয়ে ব্যবসায়ীরা এক রকম বন্দি। এক এগারোর কায়দায় ব্যবসায়ীদের নানা রকমভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, দুদকে তলব, বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হচ্ছে। ফলে এ বাংলাদেশ এখন আর ব্যবসায়ীদের নয়।
সরকার যেন গায়ে পড়ে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। যেটি সরকারের কাজ নয়। যেমন- সচিবালয়ের কথাই ধরা যাক না কেন। সরকারি চাকরিবিধির সংশোধন হবে কি হবে না, সেটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হতে পারে না। কিন্তু অন্তর্র্বর্তী সরকার সে রকম একটি কাজই করে বসল। অন্তর্র্বর্তী সরকারকে এ ধরনের কাজের এখতিয়ার কে দিয়েছিল?
এনবিআর নিয়ে অচলাবস্থা চলছে দিনের পর দিন। ফলে অর্থনীতি মুখথুবড়ে পড়েছে। সারা দেশে রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে আছে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়ায় রাজপথে প্রতিনিয়ত আন্দোলনের ফলে জনভোগান্তি চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। মানুষ তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছে না। মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে দাবি আদায়ের কৌশল হিসেবে। সাধারণ মানুষ বিরক্ত। তারা মনে করছে যে, এ বাংলাদেশ কি তাদের? আমরা বৈষম্য দূর করতে গিয়ে এক নতুন ধরনের বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে যেন এক মবতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছি। এরকম অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা প্রয়োজন। কিন্তু তা নিয়েও দেখা যাচ্ছে নতুন সংশয়, লুকোচুরি গল্প। নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের আলো-আঁধারি খেলা চলছে। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর পুরো জাতি আশায় বুক বেঁধেছিল। তারা আশা করেছিল যে, এ অচল অবস্থার অবসান ঘটবে। খুব শিগগিরই নির্বাচনের পর আমরা একটি নতুন গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তের যাত্রা শুরু করব। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার ওই বৈঠক এবং যৌথ বিবৃতির পর এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপই আমরা দেখছি না।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ডেকে নিয়েছিলেন যমুনায়। আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু সেখানে কী আলোচনা হয়েছে, সে সম্পর্কে পুরো জাতি অন্ধকারে। এনিয়ে লুকোচুরি করার কী আছে? নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে ওই বৈঠকের কথা কিছু বলেনি। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়েছে যে, এটি সৌজন্য সাক্ষাৎ। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণায় এত অনাগ্রহ কেন?
সংস্কার নিয়ে যেন রীতিমতো খেলা চলছে। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার আদলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে সংস্কার।’ তিনি বলেছেন, ‘সংস্কারের আলোচনার চেয়ে খাওয়া-দাওয়া বেশি হচ্ছে।’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন স্পষ্টতই সময়ক্ষেপণে ব্যস্ত। কিন্তু কেন? জোর করে কিছু বিষয় চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কারও কারও মধ্যে। এ খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টার এখন একটাই কাজ, তা হলো দ্রুত দেশকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া। নির্বাচন যত পেছাবে ততই মবসন্ত্রাস বাড়তে থাকবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়বে। বাড়বে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা। অর্থনীতি মুখথুবড়ে পড়বে। এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সরকারের পক্ষে এসব সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব ব্যাপার। বরং দ্রুত যদি সরকার একটি নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে দেশ রক্ষা পেতে পারে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে নানারকম টালবাহানা চলছে। কেউ কেউ আনুপাতিক নির্বাচনের কথা বলছেন। কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার কথা বলছেন, কেউ গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছেন, কেউ গণভোটের কথা বলছেন। সবকিছু মিলিয়ে যেন ইচ্ছা করেই একটা তালগোল পাকানো হচ্ছে। এ সরকার যেন একটা তামাশার নাটক চুপচাপ বসে বসে উপভোগ করছে। কিন্তু এ তামাশার নাটক সরকারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যে বিপুল জনসমর্থন এবং ম্যান্ডেট নিয়ে এ সরকার এসেছিল, সেই জনসমর্থন এখন আর নেই। মানুষ আর সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মানুষের আয়-উপার্জন নেই। অথচ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। শুধু রেমিট্যান্সের টাকা নিয়ে খুশিতে আটখানা হলে চলবে না। সংকট উত্তরণের একটাই উপায়, তা হলো নির্বাচন। সেই নির্বাচন নিয়ে সরকার যদি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, তাহলে এ সরকারের কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। রাজনৈতিক দলগুলো এখন পর্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে এ সরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে এ সরকার শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে। দেশে দেখা দেবে এক অরাজকতা এবং শূন্যতা। সেরকম অবস্থা কারও কাম্য নয়। আমরা কিছু মানুষের দেশ চাই না। আমরা সবার জন্য বাংলাদেশ চাই। সবার বাংলাদেশ করার জন্য সবার মতামত দরকার। সবার মতামতের জন্য প্রয়োজন একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল: [email protected]