ইসলাম শান্তির ধর্ম। দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি ও সুখের নিশ্চয়তার জন্য রসুল (সা.)-এর সুন্নত অনুসরণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১৪০০ বছর আগে আরবের বিশৃঙ্খল সমাজকে শান্তির কেন্দ্রস্থল বানিয়েছিলেন। তাঁর উদারতা, মহানুভবতা ও কোমলতার কাছে জগতবাসী নতজানু হতে বাধ্য হয়েছিল। আল্লাহ তাঁর রসুলকে পাঠিয়েছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর সুন্নত বা আদর্শ অনুসরণের বিকল্প নেই। সুন্নতে রসুল রসুল (সা.)-কে অনুসরণ করা আল্লাহ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যকীয় করে দিয়েছেন, তেমনি তা অনুসরণে উৎসাহিত করেছেন। যেমন সুন্নত মতো চললে মহান আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায়। মাগফিরাত লাভ হয়। আল্লাহ বলেন, ‘বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন। তোমাদের মাগফিরাত দান করবেন। আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সুন্নতে রসুল (সা.) বলতে আমরা বুঝি সর্বশেষ নবীর কথা ও কাজ। আমরা যাঁকে এককথায় নবীর আদর্শও বলতে পারি। কোরআন শরিফে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রসুলের মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ।’ অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ‘রসুল তোমাদের কাছে যা এনেছেন তা তোমরা আঁকড়ে ধর এবং তোমাদের যে কাজ করতে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাক।’ সুন্নতে রসুল (সা.)-কে অনুসরণ করলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয় না। বিদায় হজে রসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মাঝে আমি দুটি বিষয় রেখে গেলাম। যত দিন তোমরা এ দুটি বিষয় আঁকড়ে ধরে থাকবে, তত দিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ বিষয় দুটি হলো, ‘আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসুলের সুন্নত।’ সাহাবায়ে কেরাম সুন্নতে রসুল অনুসরণের গুরুত্ব বুঝেছিলেন। তাই তাঁরা পদে পদে সুন্নতের অনুসরণ করেছেন। একবার হজরত ওমর (রা.) এক সফরে যাচ্ছিলেন। চলতে চলতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থামলেন। কিছুক্ষণ বসে আবার দাঁড়িয়ে গেলেন। লোকেরা তাঁকে প্রশ্ন করল, হে খলিফা! আপনি এমন করলেন কেন জানতে পারি? উত্তরে তিনি বললেন, নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে একবার এ পথে আমরা সফরে যাচ্ছিলাম। তখন এ জায়গাটাতেই তিনি ইসতেনজা করেন। আমার এখন যদিও ইসতেনজার প্রয়োজন হয়নি, তবু তাঁর অনুসরণে আমি এখানে একটু বসলাম। একেই বলে যথার্থ অনুসরণ। ইত্তেবায়ে সুন্নতের ফল পেতে হলে রসুল (সা.)-কে একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতে হবে। অনেকে সুন্নত বলতে বোঝেন নামাজে তিনবার তসবিহ পাঠ, অজুতে তিনবার অঙ্গ ধোয়া, খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা ইত্যাদি। কিন্তু শুধু ইবাদতের সুন্নত একজন মুমিনের শান্তির জন্য যথেষ্ট নয়। ইবাদতের পাশাপাশি লেনদেন, সামাজিকতা, চরিত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নবীজি (সা.)-এর সুন্নত পালন করা খুবই জরুরি। এক ইহুদি নবীজি (সা.)-এর মেহমান হলেন। রাতে সাধ্যমতো নবীজি (সা.) তাকে আপ্যায়ন করলেন। সকালবেলা দেখেন মেহমান নেই। তার বিছানা নষ্ট হয়ে গেছে। তরবারিখানা পড়ে আছে। নবীজি (সা.) তার বিছানা সুন্দর করে সাফ করলেন। তারপর দ্রুত তার পিছু নিলেন। অবশেষে তার কাছে গিয়ে বললেন, ভাই, আপনার খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়, এই নিন আপনার তরবারি। এতে মেহমান যারপরনাই বিস্মিত হলো। কষ্ট দিয়েছেন তিনি, আর তাকে বলা হচ্ছে তিনি কষ্ট পেলেন কিনা। কী উত্তম চরিত্র! শুধু কাজে নয়, নবীজি (সা.) মুখেও ঘোষণা দিলেন, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে। অন্য হাদিসে বলেন, ‘মেহমানের সামনে যেন কারও ওপর রাগ না করে। সামাজিকতায় রসুল (সা.)-এর আদর্শ অতুলনীয়। তিনি ছিলেন একজন সচ্চরিত্র নেতা ও সুনাগরিক। নবীজি (সা.)-এর উত্তম চরিত্র সম্পর্কে কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রবান।’ এক হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, ‘আমাকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতাদানের জন্য।’ কীভাবে তিনি পূর্ণতা দিলেন; তা যেমন দিয়েছেন কাজে, তেমনি কথায়ও। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘তোমার সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তার সঙ্গে তুমি সম্পর্ক স্থাপন কর। যে তোমার ওপর জুলুম করেছে তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। যে তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে তুমি তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর।’ এ ঘোষণা তিনি শুধু মৌখিক দিয়েছেন এমন নয়, বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।
দোজাহানের সরদার তৎকালীন আরবের বাদশাহ ঘরে গিয়ে বসে থাকতেন না। যথাসাধ্য বিবিগণের কাজে সহায়তা করতেন। এক ইহুদির কাছ থেকে কর্জ করেছেন। কর্জের মেয়াদ ছিল লম্বা। কিন্তু ইহুদি তার আগেই এসে পীড়াপীড়ি শুরু করল। শুধু এতেই ক্ষান্ত হলো না। নবীজি (সা.)-এর জামা ধরে টানাটানি শুরু করল। হজরত ওমর (রা.) সইতে পারলেন না। কিন্তু নবীজি (সা.) তাকে কিছুই বললেন না। তার কর্জ পরিশোধের ব্যবস্থা করলেন। আরেকটি গল্প এমন। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্যবসায়িক কথাবার্তা চলছিল। কথা তখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভদ্রলোক বললেন, জনাব! আপনি যদি অপেক্ষা করতেন, আমি একটু ঘর থেকে ঘুরে আসতাম। নবীজি (সা.) অপেক্ষা করলেন এক... দুই... তিন দিন। তিন দিন পর ভদ্রলোক নবীজি (সা.)-কে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ লজ্জিত হলেন। জনাব! আমি বিলকুল ভুলে গিয়েছিলাম। নবীজি (সা.) তাকে কিছুই বললেন না। নবীজি (সা.) মানুষের মঙ্গলের আকাক্সক্ষী ছিলেন সব সময়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রসুলের সুন্নত অনুযায়ী চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক