এ দেশের প্রত্যেক ধর্মের মানুষই নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল। কোথাও ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটলে এ দেশের মানুষ আহত ও সংক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, কাঠামোগতভাবে ইসলামবিদ্বেষের বিষ এ দেশের প্রশাসনে, একশ্রেণির মিডিয়াতে, শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোতে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে কিছুদিন পরপরই বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটছে। শুধু তা-ই নয়, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কথিত অভিজাত অঙ্গনে ইসলামকে নেতিবাচকভাবে দেখানোর এবং ইসলাম পালনকারীদের কোণঠাসা করে রাখার প্রবণতাও ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসে ঢাকার নামকরা একটি কলেজে এক শিক্ষক হিজাব পরার কারণে ২২ ছাত্রীকে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেন। ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি পরীক্ষার নোটিসে বলা হয়েছিল, নারীদের পরীক্ষার সময় মুখ ও কান খুলে রাখতে হবে। ২০২১ সালে একটি প্রতিষ্ঠান সব যোগ্যতা থাকার পরও শুধু দাড়ি থাকার কারণে এক তরুণকে চাকরিতে অযোগ্য ঘোষণা করে।
আবার একশ্রেণির মিডিয়া দাড়ি রাখা, টাখনুর ওপর প্যান্ট পরাকে জঙ্গিবাদের লক্ষণ হিসেবে নানা সময়ে প্রচার করেছে। শুধু তা-ই নয়, নামাজ, টুপি কিংবা দাড়ির কারণে কর্মীর পদোন্নতি আটকে দেওয়া এবং কোণঠাসা করে রাখার উদাহরণও অসংখ্য। টাখনুর ওপর প্যান্ট, দাড়ি, টুপি ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। তারপরও প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একশ্রেণির মিডিয়া কর্তৃক ইসলামের এসব সিম্বলকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা এবং কোণঠাসা করে রাখা কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষের ধারাবাহিকতা। আমরা সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাই জ্ঞান অর্জন করার জন্য, ইসলামবিদ্বেষী হওয়ার জন্য না। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষকদের মানসিকতা, শিক্ষা কারিকুলাম এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলাম পালনকারীদের সেকেলে, কুসংস্কারচ্ছন্ন, পিছিয়ে পড়া মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে তরুণদের একটি বড় অংশ ইসলামের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠছে। এখানেও ভূমিকা রাখছে কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি বহুদিনের। অথচ সেই দাবি পূরণ না করে গানের শিক্ষক নিয়োগের তোড়জোড় চলছে। এ দেশের কত পার্সেন্ট বাবা-মা সন্তানকে গান শেখান? সংখ্যাটা খুবই কম। কিন্তু প্রায় সব বাবা-মা চান, তার সন্তান যেন জাগতিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাটাও পায়। এ জন্য তারা সন্তানকে মক্তবে পাঠান কিংবা বাসায় ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে সরকার যদি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিত, তাহলে অভিভাবকদের এই বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হতো না। স্কুলই তাদের প্রাথমিক ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত। অথচ সেই গণদাবিকে উপেক্ষা করে অল্পসংখ্যক মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে গানের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের অবকাঠামোর ভিতর যেহেতু বহুকাল ধরে ইসলামবিদ্বেষের বীজ বপিত হয়ে আছে, তাই ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ তাদের কাছে অপছন্দীয় এবং অবান্তর কাজ মনে হচ্ছে। অথচ একটি দেশের এগিয়ে যাওয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়া। আমরা মালয়েশিয়ার উদাহরণ আনতে পারি। মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং থেকে অনেক এগিয়ে। শুধু পড়াশোনাই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা আমাদের চেয়ে বহু গুণ এগিয়ে। অথচ এই উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য তারা ইসলামকে বাধা মনে করেনি। ইসলামি মূল্যবোধকে পুরোপুরি ধারণ করেও যে উন্নতির শিখরে ওঠা যায়, তার বড় উদাহরণ মালয়েশিয়া। ক্রমবর্ধমান ধর্ম অবমাননা দেশের জন্য অশনিসংকেত। যদি ক্রমাগত এটা ঘটতেই থাকে আর রাষ্ট্র যদি এর বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ না নেয়, তবে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ একসময় ভেঙে যাবে। তারা বাধ্য হবে আইন হাতে তুলে নিতে। এতে রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতা চরমভাবে ব্যাহত হবে। তাই অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রের তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি। এক. দেশের সব জায়গায় ধর্মচর্চাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে। দুই. কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষ দূর করতে হবে। তিন. ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তা কার্যকর করতে হবে। অতিসত্বর এই তিনটি পদক্ষেপ যদি গ্রহণ না করা হয়, তবে কুচক্রী মহল পরিকল্পিত ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটিয়ে দেশকে অস্থির করে তুলতে পারে। তাই শান্তি, শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
জুমার মিম্বর থেকে
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ