বুড়িগঙ্গা। এক দিন এই নদী ছিল বাংলাদেশের প্রাণ। কিন্তু আজ? আজ বুড়িগঙ্গা শীর্ণ এক নদী। বুড়িগঙ্গায় এখন স্বচ্ছ পানি পাওয়া দুরাশার শামিল। নদীবক্ষের অধিকাংশজুড়ে আছে কালো, নীলাভ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির প্রবাহ; যা জীবাণুযুক্ত ও স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই পানি ঢাকা নগরীর কলকারখানার বর্জ্য এবং প্রতিদিনকার বিপুল পরিমাণ মল ও আবর্জনা মিশ্রিত। এ পানিতে গোসল, কাপড়কাচা, বাসন মাজা আর রান্নাবান্নাসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার পর্যন্ত সবকিছুই হচ্ছে। নদীতীরে গড়ে উঠেছে জাহাজ নির্মাণ কারখানা।
ধোলাইখাল দিয়ে রাজধানীর যাবতীয় ময়লা পানি গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। যে জায়গাটিতে খালটি বুড়িগঙ্গায় মিশেছে সেখানে গেলেই চোখে পড়বে এক নারকীয় দৃশ্য। এখানে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বুড়িগঙ্গার পানি দুর্গন্ধ। পানিতে ভাসছে মরা মাছ, পশুপাখির নাড়িভুঁড়ি। ভাসছে হাজার হাজার পলিথিন ব্যাগ। এক মাইলব্যাপী এলাকার পানিতে সারাক্ষণ বুঁদবুঁদ উঠতে দেখা যায়।
বুড়িগঙ্গা দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ লঞ্চ আসা-যাওয়া করে। এসব নৌযান থেকে তেল অনবরত নদীতে মিশে থাকে। এ ছাড়া চলে প্রতিদিন প্রায় হাজারখানেক ইঞ্জিনচালিত নৌকা। পানির ওপর তেলের বিশাল আস্তরণ মাঝে মাঝে খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। বুড়িগঙ্গার ডানদিকে অবস্থিত ডকইয়ার্ডে বিভিন্ন ধরনের যাত্রী ও মালবাহী জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙা হচ্ছে। এই ডকইয়ার্ডের যাবতীয় আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। সব মিলিয়ে বুড়িগঙ্গা দূষিত ও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। পাগলায় অবস্থিত ঢাকা ওয়াসার আউটফল স্যুয়ারেজ লাইনের ত্রুটির কারণে বেশ কিছুদিন মহানগরীর মল পরিশোধন ছাড়াই বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। এ ছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন কারণে প্রচুর মল পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। ইসলামবাগ, চাঁদনীঘাট, কামরাঙ্গীরচর, মান্দাইল, বড়িশুরসহ নদীর উভয় তীরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার প্রায় ৭ হাজার উন্মুক্ত পায়খানা রয়েছে নদীর ওপর। ফলে এই নদীর পানি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে উঠেছে।
ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় ছোটবড় প্রায় সাড়ে চার শ ট্যানারি। এর মধ্যে মাত্র ১০০টি ট্যানারি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। এসব ট্যানারির বর্জ্য ড্রেন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। ট্যানারি শিল্পে ‘ক্রোসমল’ জাতীয় এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিন একটি কারখানা ১০-১৫ টন ক্রোমসল ব্যবহার করে। প্রতিটি ট্যানারির ৩ হাজার গ্যালন ‘ডাস্ট ওয়াটার’ প্রতিদিন পড়ছে সোজা বুড়িগঙ্গায়। ফলে নদীর পানিতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ট্যানারির বর্জ্যে ক্ষতিকর আর্সেনিকও রয়েছে। প্রতিদিন ট্যানারির হাজার হাজার গ্যালন বর্জ্য পানি বুড়িগঙ্গায় পড়ার ফলে নদী বিষাক্ত হচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ পলি পড়ে। ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম ও আর্সেনিক পলির সঙ্গে জমা হচ্ছে। ফলে শুধু পানিই বিষাক্ত হচ্ছে না, বুড়িগঙ্গার মাছও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকদের অভিমত, শরীরে ক্রোমিয়ামের মাত্রা অধিক হলে ক্যানসার হতে পারে। অথচ হাজারীবাগ এলাকায় গেলেই দেখা যাবে ড্রেনগুলো দিয়ে স্রোতধারায় হালকা সবুজ ও নীল রঙের ট্যানারি বর্জ্য পানি বুড়িগঙ্গায় যাচ্ছে। এর সবটাই ক্রোমিয়াম যুক্ত।
বুড়িগঙ্গার তীরে রয়েছে মিটফোর্ড হাসপাতাল। এ হাসপাতালের জীবাণুযুক্ত যাবতীয় পানি ও বর্জ্য ড্রেন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। তাছাড়া হাসপাতালের রোগীদের ব্যবহৃত পোশাক, বিছানার চাদরও বুড়িগঙ্গায় ধোয়া হচ্ছে। ফলে নানান জটিল রোগের জীবাণু মিশছে বুড়িগঙ্গার পানিতে। এ নদীতে প্রতিদিন নিম্নবিত্ত, বিত্তহীনদের গোসল করতে দেখা যায়। প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার নারী-পুরুষ গোসল করে। কাপড় কাচা থেকে হাঁড়ি-পাতিল ধোয়ামাজা পর্যন্ত। এমনকি কলসি ভরে অনেকে পানি নিয়ে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর। নদীতে এসে কেন ট্যাপ থাকা সত্ত্বেও নদীর পানি কেন ব্যবহার করেন এ সম্পর্কে গোসলকারীদের মতামত হলো- প্রয়োজনীয় পানির খুব অভাব। স্থানীয় সব হোটেলে ওয়াসার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে হাতমুখ ধোয়ার জন্য বুড়িগঙ্গার পানি তুলে রাখে। কিছু লোক টিনভর্তি করে এসব হোটেলে পানি সরবরাহ করে থাকে। একজন পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, বুড়িগঙ্গা ক্রমাগত দূষিত হয়ে পড়ছে। অথচ বুড়িগঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণের যেমন উদ্যোগ নেই, তেমনি দূষণ কী হারে বাড়ছে তারও পর্যবেক্ষণ নেই। শুকনো মৌসুমে বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট