হাসান হাফিজের অনেক পরিচয়। সে মূলত কবি। বেশ অনেকগুলো কবিতার বই বেরিয়েছে। কাব্যসমগ্রও বেরিয়ে গেছে তিন চার খণ্ড।
এখনো নিয়মিত লিখছে। তার কলম চলছে যন্ত্রের মতো। লেখালেখির শুরুর দিক থেকেই সাহিত্যের অনেক শাখায় বিচরণ। শুরু করেছিল ছড়া লিখে। তারপর ছোটদের কবিতা, গল্প, রূপকথা। লেখালেখির শুরুরকালে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সাহিত্য জগতে দাঁড়াবার জায়গা তৈরি করতে চাইছিল সে।
হাসান হাফিজকে ‘তুমি’ করে বলছি বিশেষ কারণে। সে আমার কৈশোরকালের বন্ধু। আমার আগেই লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেছিল। আসলে তো বলি ‘তুই’ করে। সে তো আর লেখা যায় না। এ এক বিপদ। আপনি করে বললে দূরের মানুষ মনে হয়। তুই করে বললে ভালো শোনায় না। তুমি করে বলাটা মানানসই ও শোভন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রূপকথার অনুবাদ, বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী ও নানা রকম সম্পাদিত গ্রন্থের কাজ দু’হাতে চালিয়ে যাচ্ছিল হাসান হাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। ছাত্র হিসেবে তুখোড়। একসময় কবিতা লিখতে শুরু করল। পাশাপাশি শুরু হলো তার সাংবাদিকতার জীবন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের বিখ্যাত দৈনিক ‘দৈনিক বাংলা’র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে শুরু হয়েছিল তার সাংবাদিকতার জীবন। সাংবাদিকতার মূল ধারায় যুক্ত হয়ে গেল একসময়। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দেশ’-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করল অনেক বছর। ‘দেশ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখত ‘ঢাকার চিঠি’। ফলে দুই বাংলাতেই তার বিশেষ পরিচিতি গড়ে ওঠে।
কবি হেলাল হাফিজ তার নাম করে দিয়েছিলেন হাসান হাফিজ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলো ’৮২ সালে। ক্রাউন সাইজের সেই বইটির কথা এখনো আমার মনে আছে। নাম ‘এখন যৌবন যার’। হেলাল হাফিজের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন থেকে নেওয়া ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।
এই বই থেকেই জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল হাসান হাফিজের।
কবি হাসান হাফিজ যেমন তার লেখালেখির জগতে বড় অবদান রেখে চলল, ঠিক সে রকম অবদান রাখতে লাগল সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে। এখন সে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি। অন্যদিকে ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’র সম্পাদক। এই দুই বড় দায়িত্বে থাকার পরেও লেখালেখির কলমটি থেমে যায়নি তার। নিয়মিতই কবিতা লেখা চলছে। পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক সাহিত্যের পাতায়ও নিয়মিত ছাপা হচ্ছে তার লেখা।
হাসান হাফিজকে নিয়ে বলতে হলে নিজের কথাও অনেকখানি বলতে হয়। ১৯৭৩ সালের কথা। প্রথম হাসান হাফিজকে দেখি ‘অবজারভার ভবন’-এ। ওই ভবন থেকে বের হতো ‘দৈনিক পূর্বদেশ’। পূর্বদেশের ছোটদের পাতা ‘চাঁদের হাট’। সেখানে জীবনের প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে আমার। কিশোর গল্প। নাম ‘বন্ধু’। গল্প প্রকাশের কয়েক দিন পর ‘চাঁদের হাট’-এর পাতায় দেখলাম পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে অনুষ্ঠান হবে পূর্বদেশ অফিসে। আয়োজক ‘চাঁদের হাট’ পাতার যিনি সম্পাদক তিনি। পরে তাঁর নাম জেনেছি, রফিকুল হক। ‘দাদুভাই’ নামে যিনি পরিচিত এবং বিখ্যাত ছড়াকার। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ‘চাঁদের হাট’-এ যারা নিয়মিত লেখালেখি করে, সদ্য কৈশোর পেরোনো কিছু ছেলেমেয়ে, তাদের নিয়ে একটি সাহিত্যের অনুষ্ঠান করবেন।
গেন্ডারিয়া থেকে আমিও গিয়েছি। ‘বন্ধু’ গল্পের সুবাদে সেই অনুষ্ঠানে আমি পেয়ে গেলাম পরবর্তী জীবনের অনেক প্রিয় বন্ধুকে। যেমন ফরিদুর রেজা সাগর, আফজাল হোসেন, আবদুর রহমান, সাইফুল আলম, সাহানা বেগম, আলীমুজ্জামান, এনায়েত রসুল, শুশুমনি, মুনা মালতী, একটু সিনিয়র আলী ইমাম, সিরাজুল ইসলাম, ফিউরি খোন্দকার। পরবর্তী সময়ে দিদারুল আলম, খন্দকার আলমগীর প্রমুখ। ওই অনুষ্ঠানেই পরিচিত হয়েছিলাম হাসান হাফিজের সঙ্গে। তখন তার অন্য একটা নাম ছিল। নামটি আমি আর এখন বলতে চাই না। হাসান হাফিজ নামের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে সে-ই নাম। পরিবারের মানুষজন আর পুরোনো বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ মনে রাখিনি।
হাসান হাফিজের হাতের লেখা মুক্তোর মতো। একটু উচ্চ স্বরে কথা বলার স্বভাব। যেখানে থাকে, সে-ই জায়গা গরম করে রাখে। এখনো সে-ই স্বভাব অনেকখানি রয়ে গেছে তার। পরবর্তী জীবনে হাসান হাফিজ বিশাল কবি হয়ে উঠল। চমৎকার কবিতা লেখে। বাংলা ভাষাটা খুব ভালো জানে। বাংলা বানানের মাস্টার। এত দিন লেখালেখির বয়স হয়ে গেল, তার পরও আমার নিজের বহু বানান ভুল হয়। লিখতে বসে কোথাও আটকে গেলে হাসান হাফিজকে ফোন করি। বন্ধু, অমুক বানানটা বল তো।
সঙ্গে সঙ্গে সঠিক বানানটা পেয়ে যাই।
হাসান হাফিজের স্মৃতিশক্তিও প্রখর। সন তারিখসহ অনেক ঘটনা সে বলে দিতে পারে। স্মৃতিতে একটুও মরচে ধরেনি।
সাংবাদিকতার কাজে দেশবিদেশ চষে বেড়ায় হাসান হাফিজ। অন্তরজুড়ে তার কবিতা। আপাদমস্তক কবিতায় মত্ত হয়ে আছে। বাংলা একাডেমি বইমেলায় প্রতি বছরই প্রকাশিত হচ্ছে তার নানা ধরনের বই। ম্যারাডোনাকে নিয়ে তার একটি বই আছে, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আছে একটি সম্পাদিত গ্রন্থ। এরকম বহু কাজ তার। আমাকে নিয়ে একশো লাইনের একটি ছড়া লিখেছিল। এক ছড়ায় এক বই। বইটি প্রকাশিত হয়েছে কি না, জানি না। তিন তিনটি বই আমাকে উৎসর্গ করেছে। এ আমার পরম সৌভাগ্য। হাসান হাফিজকে নিয়ে একটি ঘটনা বলি।
বহু বছর আগের কথা। মুন্সীগঞ্জে সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। আমরা দুজনই তখন একেবারে তরুণ। একজন কবি হিসেবে, আরেকজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে সামান্য পরিচিত হয়ে উঠেছি। ওই সাহিত্য সম্মেলনে আমরা দুজনই দাওয়াত পেয়েছি। দিনভর সাহিত্য সম্মেলন হলো। কবিতাপাঠ শুরু হলো সন্ধ্যায়। তখন মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে হতো লঞ্চে করে। অনেক রাত হয়ে গেছে। লঞ্চ নেই। মুন্সীগঞ্জেই থেকে যেতে হলো। হাসান হাফিজের পরিচিত একজনের বাড়িতে থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা হলো। খাওয়াদাওয়ার পর ছোট একটা ঘরে চৌকির ওপর শোয়ার ব্যবস্থা। দুই বন্ধু শুয়ে পড়লাম। শোয়ার পর তিরিশ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট, হাসান হাফিজ গভীর ঘুমে ডুবে গেল। ঘুমন্ত মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়। ওরকম শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। আমি হতভম্ব! এত তাড়াতাড়ি, এভাবে অচেনা এক বাড়ির বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া যায়!
আমি সারা রাত উসখুস করলাম। হাসান হাফিজ একটানা ঘুমাল। সকালবেলা ফ্রেশ যুবকটি হয়ে চোখ মেলল। আমার যেটুকু তন্দ্রামতো এসেছিল, তা-ও ভেঙে গেছে অতি ভোরে। বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সকালবেলার আকাশ দেখা আমার প্রিয় অভ্যাস। সকালবেলার আকাশ আমার কাছে প্রতিদিনই নতুন। সে-ই নতুন আকাশ দেখছি। রাতে গভীর ঘুম হলে সকালবেলা শরীর-মন দুটোই প্রফুল্ল থাকে। হাসান হাফিজ প্রফুল্ল। বিছানায় উঠে বসেই আমাকে বলল, কী রে! এখনো তার সে-ই ঘুমের কথা আমার মনে পড়ে। সে-ই সকালটির কথা মনে পড়ে।
হাসান হাফিজ সত্তরে পা রাখল। বয়স হলে মানুষের ঘুম কমে আসে। জানি না, ওর ঘুম কমেছে কি না। যদি সে-ই আগের মতো ঘুম ঘুমাতে পারে, তা হলে তার মতো সুখী মানুষ আর কে আছে! হƒদয়ভর্তি কবিতা আর চোখভর্তি ঘুম নিয়ে প্রিয় বন্ধু হাসান হাফিজ, তুমি আরও বহু বছর বেঁচে থাকো, তোমার জন্মদিনে এই কামনা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক