নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) একজন বিখ্যাত ওলি, চিশতিয়া তরিকার প্রখ্যাত সুফি ও আধ্যাত্মিক পীর ছিলেন। তাঁর মূল নাম মুহাম্মাদ এবং পুরো নাম শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া। সুলতান উল আউলিয়া, সুলতান উল মাশায়েখ, সুলতান উল সালাতিন, মাহবুবে এলাহি ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য উপাধি। তবে ‘নিজামুদ্দিন আউলিয়া’ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ উপাধি।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া ৬৩৫ হিজরি উত্তর প্রদেশের দিল্লির পূর্বে বদায়ুনে ২৭ সফর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আবদুল্লাহ বিন আহমদ আল-হোসাইনী বদায়ুনী এবং মাতা সৈয়দা বিবি জুলেখা। জানা যায় তিনি হজরত আলী (রা.)-এর বংশধর ছিলেন।
নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মূল নাম মুহাম্মাদ হওয়ার পরও পিতা তাঁকে আদর করে নিজামুদ্দিন বলে ডাকতেন। তিনি অল্প বয়সেই পিতার সঙ্গে থেকেই ইসলামি শিক্ষা অর্জন করে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল ছিলেন। পিতার সঙ্গে ধ্যানসাধনাও করতেন। খাবারের চেয়ে রোজাই প্রিয়- তাই ফরজ হওয়ার আগে পিতার সঙ্গে লাগাতার রোজা রেখেছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)। মায়ের কোলে থেকে বিভিন্ন ওলির জীবন থেকে শিক্ষা নিতেন। কেননা মা তাঁকে ওলিদের সম্পর্কে জানাতেন। মা বলতেন, আল্লাহ তোমাকে উচ্চমর্যাদা দান করুন। তুমি তোমার পিতা ও নানার অনুসরণ করবে। ইলম অর্জন করে প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসার মাধ্যমে তাঁর সব আদেশ ও নিষেধ পালন করবে। প্রিয় নবীর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া তোমার জন্য বেশ জরুরি। ছোটকাল থেকেই তিনি তাঁর মায়ের উপদেশ গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনে তা পালনের চেষ্টা করতেন।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-এর পাঁচ বছর বয়সেই পিতা দুনিয়া ত্যাগ করেন। অতঃপর মা তাঁকে দিল্লিতে নিয়ে এসে বিখ্যাত আলেম মাওলানা শামসুদ্দীন ও মাওলানা কামালুদ্দীন জাহেদের কাছে শিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি করান। নিজামুদ্দিন আউলিয়া অসাধারণ মেধাবী হওয়ায় খুব কম সময়েই জাহের ইলমসমূহের সনদ পেয়ে সব শাস্ত্রেই পারদর্শিতা অর্জন করে সেরা আলেমদের মধ্যে গণ্য হয়ে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সঠিক পরামর্শের কারণে ১২ বছর বয়সেই শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটায় মহান এই ওলি নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)। তবে শিক্ষাজীবন শেষ হতে না-হতেই মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মায়ের দুনিয়া ত্যাগের দিন সকালে মা নিজেই নিজামের হাত ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দোয়া করেন, ‘হে মহান আল্লাহ, আমি নিজামকে আপনার কাছে সোপর্দ করছি। আজ থেকে সে আপনার নিজাম।’ এ কথা শেষ করেই মায়ের চোখ বন্ধ হয়ে যায়। বিদায় হন মমতাময়ী মা। মায়ের মৃত্যুতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া কিছুটা ভেঙে পড়েন। কেননা পিতার বিদায়ের পর মায়ের ভালোবাসা ও মমতায় বড় হন নিজামুদ্দিন আউলিয়া। তাঁর মা কখনোই পিতার অভাব বুঝতে দেননি। অভাব-অনটনের সংসারে মা নিজেই সুতাসহ অন্য কাজ করে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। অভাব-অনটনের সংসার মা জুলেখা অতিকষ্টে জীবন কাটিয়েছেন। নিজে কষ্ট করেছেন তবে সন্তানকে মমতা দিয়ে ভরপুর করে রেখেছেন। সেই আত্মত্যাগী মমতাময়ী মাকে কখনো ভোলা যায় না। মায়ের কথা মনে পড়লেই কান্নায় অশ্রুসিক্ত হতেন নিজামুদ্দিন আউলিয়া। মায়ের প্রতি তাঁর ছিল ভক্তি, ভালোবাসা ও দরদমাখা মমতা এবং সম্মান।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) আজোধানে বর্তমানে পাকিস্তানের পাকপাত্তান শরিফ আগমন করে সুফিসাধক ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকারের কাছে শরণাপন্ন হয়েছিলেন। ১২ কিংবা ১৩ বছর বয়স থেকেই সুফি শায়েখ ফরিদ উদ্দিন (রহ.)-এর প্রতি তাঁর মনে সম্মান ও ভালোবাসা জন্মাতে থাকে। তাঁর জীবিনকালে তিনি সুফি ফরিদ উদ্দিন (রহ.)-এর দরবারে তিনবার গিয়েছেন এবং সর্বশেষ সুফি ফরিদ উদ্দিন (রহ.) তাঁকে উত্তরসূরি বা খলিফা মনোনীত করেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) খলিফা মনোনীত হয়ে দিল্লিতে ফিরে আসেন। কিছুদিন পর সুফি ফরিদ উদ্দিন (রহ.) দুনিয়া ত্যাগ করেন।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) খলিফা মনোনীত হয়ে দিল্লির বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি সর্বস্তরের মানুষের সেবা, জাগতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার জন্য দিল্লিতে খানকা স্থাপন করেন। অল্প দিনেই খানকাটি ধনীগরিবসহ সবার কাছে পরিচিতি লাভ করে।
দলে দলে লোকজন নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-এর খানকায় এসে বিভিন্ন সেবাসহ আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম নাসিরুদ্দিন চিরাঘ দেহলভী, কবি সুফি আমীর খসরু, সৈয়দ জালালুদ্দীন হোসেন বুখারি ওরফে শরিফের মখদুম জাহানিয়ান জাহাঙ্গশত, আখি সিরাজ আইনায়ে হিন্দ, বুরহানউদ্দিন গরীব প্রমুখ।
লেখক : ইসলামিক গবেষক
সূত্র : উইকিপিডিয়া, আইন-ই-আকবর, ওলির জীবনী