ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামের প্রসিদ্ধ চার ইমামের দিকে আমাদের বিচারকদের দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। এতে যদি আমাদের দুনিয়ার ক্ষণিকের দুঃখ-বেদনা সহ্য করতে হয় তবু তা আখেরাতের অনন্তকালের সুখ-শান্তি অর্জনে সহায়তা করবে নতুবা কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। ইসলাম একমাত্র দীন। এই দীন ইসলামের বাণী পালন করতে গিয়ে চার প্রসিদ্ধ ইমামের ত্যাগ স্বীকার আমাদের জানা উচিত।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে ইরাকের শাসক বললেন, হে ইমাম আপনি বাগদাদের প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করুন। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, হে খলিফা! আপনার দয়ায় আমি প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ আর আপনার অন্যায় বিচারের পক্ষে আমি রায় সই করে দেব? প্রধান শাসক হিসেবে আপনার তরবারি একদিকে আর আমার রায় হবে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে, তাই আমি আবু হানিফা আপনার আদেশ মতে বিচার কখনো করতে পারব না। ইমাম আবু হানিফার এ কথায় তাঁকে বাগদাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো এবং সর্বাধিক বিশ্বস্ত মতে তাঁকে কারাগারে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হলো। ইমাম মালেক বিন আনাস (রহ.) কাছে লোক পাঠিয়ে বলতে বলা হলো হে মালেক তুমি বলো, ‘হিল্লা/ঠিকা বিয়ে জায়েজ’। সমস্ত আলেমগণ জায়েজ বললেও ইমাম মালেক এতে সম্মত নন মর্মে জানালেন। তখন ইমাম মালেককে ধরিয়ে এনে বলা হলো আপনি কাজি হয়ে যান এবং হিল্লা বিয়ে জায়েজ রায় দেন। তিনি উত্তরে বললেন, আমি কাজি হতে পারব না, কারণ আপনি যা বলছেন এটা চিরদিনের জন্য কোরআন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তখন ইমাম আনাস ইবনে মালেককে একটি পেট খারাপ উটনীর লেজের পেছনে তার দেহ ঝুলিয়ে দেওয়া হলো এবং লাঠি দিয়ে পিটিয়ে উটনীর মলমূত্র তার দেহে পড়তে লাগল। এভাবে তাকে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া হয়েছিল তবু তিনি আল্লাহর বাণীর প্রতি অবিচল ছিলেন। ইমাম সাফি (রহ.)-কেও বলা হয়েছিল, এই ফতোয়া আপনি দেন, তিনি বললেন, আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তখন তাঁকে বলা হলো বাগদাদ থেকে বেরিয়ে যান। তিনি বাগদাদ থেকে বেরিয়ে মিসরের পথে যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন আমি মিসরে যাচ্ছি না, কবরের দিকে যাচ্ছি! তিনি মিসরে পৌঁছলেন এবং সেখানে মারা গেলেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) যিনি ১০ লাখ হাদিসের হাফেজ। তাঁকে বলা হয়েছিল তুমি বলো, ‘কোরআন সৃষ্ট, তিনি বললেন, কোরআন গায়েবে মাখলুক। এর শাস্তি হিসেবে তাঁকে ২৮ মাস জেল খাটানো হলো, দিনে একটি রুটি খাওয়ানো হতো অথচ তিনি তা বললেন না। ওই সময়কার অনেক আলেম বললেন, হে ইমাম আহমেদ আপনাকে যেভাবে আঘাত করা হচ্ছে তাতে আপনার কষ্ট হচ্ছে। আপনি বলেন, এতদসত্ত্বেও তিনি বলতে অস্বীকার করলেন।
এভাবে তৎকালীন সময়ের শাসকরা নিজেদের খেয়াল-খুশি/ ইচ্ছামতো বিচারকার্য চালিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিশ্বেও যুগ যুগ ধরে অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে এর চলন আছে। Several guilty persons may escape than one innocent person should suffer মুসলিমরা মানব প্রণীত এ আইন অধ্যয়ন করলেও তা মানতে বাধ্য নই।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ তোমরা ইনসাফের ওপর দৃঢ়ভাবে কায়েম থাক। অতএব তোমরা কখনো ন্যায়বিচার করতে গিয়ে নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।’ যদি তোমরা পেঁচানো কথা বলে ইনসাফ থেকে বিরত থাক, তাহলে জেনে রাখ আল্লাহ সব কিছুর খবর রাখেন (সুরা নিসা-১৩৫)। আল্লাহ আরও বলেন, মানুষকে ভয় কর না আমাকে ভয় কর; আর যারা আল্লাহর নাজিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না তারাই হচ্ছে কাফেলা (সুরা মায়েদা-৪৫)। সুনানে আবু দাউদে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সঠিক জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে রায় দেয়, সে জাহান্নামে যাবে। সহিহ বুখারির-৬৬৬৬ নম্বর হাদিসেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। আল্লাহ আমাদের সঠিক বিচারব্যবস্থা সমুন্নত রাখার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক