সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব দল এতে স্বাক্ষর করবে কি না তা নিশ্চিত নয়। গত মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সনদের কপি পাঠানো হয়েছে। এই কপি পড়ে মনে হলো ঐকমত্য কমিশন যেন ঐক্যের চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতেই বেশি আগ্রহী। কথা ছিল, যেসব বিষয়ে সব পক্ষ একমত হবে কেবল সেইসব বিষয়ই সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু যে কপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, অনৈক্যের বিষয়গুলোও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কে কে কোন বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করছে তা উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুতে এ রকম কথা ছিল না। তাদের মতে, যেটুকু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত শুধু সেই সব বিষয় নিয়ে এ সনদ চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। রাজনৈতিক দলের বিরোধগুলোকে চিহ্নিত করে কমিশন বিভক্তির পথ উসকে দিল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। লক্ষণীয় যে, অধিকাংশ মতপার্থক্যের বিষয়গুলো আগামী নির্বাচনের আগে অপ্রাসঙ্গিক।
এসব বিষয় নিষ্পত্তির জায়গা কমিশন নয়, জাতীয় সংসদ। যেমন জুলাই সনদে ৪ নম্বর প্রস্তাবে সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। পৃথিবীর কোনো দেশের উচ্চকক্ষের এ ধরনের দায়িত্ব বা ক্ষমতা নেই। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাব সমর্থন করেনি। এখনো উচ্চকক্ষ গঠিত হয়নি। উচ্চকক্ষের অবয়ব এবং কার্যপরিধি ঠিক করবেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। তাহলে কেন এটি জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা? জুলাই সনদের ১১ নম্বর প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কিত। এতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন, আইন কমিশনের মতো ছয়টি কমিশন গঠনের একক ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সদস্য নিয়োগের একক এক্তিয়ার রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এটি সংসদীয় গণতন্ত্রের চেতনার পরিপন্থি। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল এ কারণেই এই প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের ১৫ নম্বর সুপারিশে প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্যই শুধু নয়, বিশ্বের গণতন্ত্র চর্চা ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে এই প্রস্তাব সাংঘর্ষিক। এতে রাজনৈতিক দলের চেইন অব কমান্ড নষ্ট হবে। দলগুলোতে কোন্দল সৃষ্টি হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতন্ত্র। কমিশন ১৬ নম্বর সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রক্রিয়াকে জটিল এবং দুর্বোধ্য করে তুলেছে। আমাদের সংবিধানে ২০১১ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল। সেটি চালু করলেই সমাধান সম্ভব। অথচ এটাকে এমন জটিল করা হয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্যই আলাদা কমিশন লাগবে। যৌক্তিক কারণ, বিএনপি ও আরও কয়েকটি দল এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে। কিন্তু তারপরও কমিশন এই প্রস্তাব সংযুক্ত করেছে। কার স্বার্থে?
পিআর পদ্ধতি নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক চলছে। জামায়াত কৌশলগত কারণে পিআর পদ্ধতি সামনে এনেছে। এটি তাদের প্রচারণার কৌশল। এই রাজনৈতিক বিতর্ক কি জুলাই সনদে রাখা ঠিক হয়েছে? কমিশন এই বিতর্কিত ইস্যু সনদের সুপারিশে সামনে এনেছে। কমিশন, নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করেছে। সংগত কারণেই বিএনপি এবং আরও কয়েকটি দল এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা-সংক্রান্ত প্রস্তাবে একটি বিল অনুমোদন দিতে দুই মাস পর্যন্ত সময় নিতে পারবে। এতে সরকার পরিচালনায় অনাকাঙ্ক্ষিত ধীরগতি সৃষ্টি হবে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল এই সময়সীমা এক মাসে সীমিত রাখার প্রস্তাব করেছে। আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব সরকার পরিচালনা সম্পর্কে তাদের অনভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ২৬ নম্বর সুপারিশে সব আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদের অনুমোদনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি থাকে গোপনীয়, তা প্রকাশ না করা চুক্তির অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি তার একটি উদাহরণ। এ রকম বেশ কিছু সুপারিশ রয়েছে, যা সরাসরি সরকার পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি করবে। যেমন- একটির বদলে তিনটি কর্মকমিশন গঠন করা হবে কি না তা সরকারের সিদ্ধান্ত। এটা জুলাই সনদে অপ্রয়োজনীয়। একইভাবে, ৪২ নম্বর প্রস্তাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার প্রস্তাব অবাস্তব শুধু নয়, হাস্যকরও বটে। একইভাবে আইনজীবী সমিতি এবং বার কাউন্সিলের নির্বাচন নিয়ে ৬০ নম্বর প্রস্তাব নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল। জুলাই সনদের মূল চেতনা হলো- ঐক্যের বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ঐক্যের জায়গা সংহত করে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু এই দলিলে বিভক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সবাই যদি শেষ পর্যন্ত এই সনদে স্বাক্ষরও করে তাহলে এর বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? বিএনপি যে প্রস্তাবে রাজি না, তারা নির্বাচনে জিতলে সেই প্রস্তাব কেন গ্রহণ করবে? আবার জামায়াত যদি বিজয়ী হয় তাহলে কি তারা বিএনপির প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করবে? এজন্যই এই সনদের প্রধান আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত গণতন্ত্রে উত্তরণ। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ঠিক করবেন আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে।