চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি সম্প্রতি তাদের নতুন প্রজন্মের টাইপ ১০০ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক উন্মোচন করেছে, যা বিশ্বজুড়ে সামরিক কৌশল এবং স্থলযুদ্ধের সংজ্ঞাকেই পাল্টে দিতে পারে। ঐতিহ্যবাহী স্বল্প-পাল্লার লড়াই থেকে সরে এসে দূরপাল্লার আক্রমণে সক্ষম এই অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক চীনকে সামরিক উদ্ভাবনের একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে এসেছে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিবর্তন কেবল চীনের সামরিক সক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে না বরং ভবিষ্যতের বিশ্ব সামরিক ভারসাম্যে গভীর প্রভাব ফেলবে।
নতুন এই ট্যাংক সাধারণ থার্মাল সাইট, নাইটভিশন বা ট্যাংক কমান্ডারের সাইটে দেখা যায় না এমন এমন দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে পারে। একইসঙ্গে এর রয়েছে নেটওয়ার্কভিত্তিক যুদ্ধ পরিচালনার সক্ষমতা। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হচ্ছে, দৃষ্টিসীমার প্রচলিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে আঘাত হানবে এই ট্যাংকের ছোড়া গোলা ও মিসাইল। তবে এখানে শুধু খালি চোখে দেখার সীমাকেই বলা হচ্ছে না, যার প্রচলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই ফুরিয়ে আসে। তাছাড়া আধুনিক ট্যাংকের সাইট ও সেন্সর সেই দৃষ্টিসীমাকে বহুদূর বিস্তৃত করে, তবে তারও একটা সীমা আছে। সেটাকেই দৃষ্টিসীমার প্রচলিত গণ্ডি বলা হচ্ছে এখানে।
পিএলএ-র এই নতুন ট্যাঙ্ক স্থলযুদ্ধের ধারণায় মৌলিক পরিবর্তন আনছে। পিএলএ ডেইলির রিপোর্ট অনুযায়ী, টাইপ ১০০ ট্যাঙ্ক পিএলএকে নিকটবর্তী সংঘাত থেকে দীর্ঘ-পাল্লার যুদ্ধ, সবকিছুতেই সক্ষম করে তুলছে। ট্যাঙ্ক কমান্ডার সুন ইয়োংমিং এই অগ্রগতিকে যুগান্তকারী আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ট্যাঙ্কটি অপটিক্যাল, ইনফ্রারেড এবং রাডার সেন্সর ব্যবহার করে ব্যাপক যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।
'বিজয় দিবস' সামরিক কুচকাওয়াজে আত্মপ্রকাশ করা টাইপ ১০০ ট্যাঙ্কে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অপটিক্যাল ও রাডার সেন্সর এবং নেটওয়ার্ক-ভিত্তিক যুদ্ধের ক্ষমতা যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে এটি দ্রুত চলাচল করতে এবং কৌশলগত অবস্থান নিতে সক্ষম। এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পিএলএ-র হেলিকপ্টার, রকেট লঞ্চার, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ইউনিট এবং ড্রোন সহ বিভিন্ন সামরিক ইউনিটকে একটি সুসংহত, তথ্য-কেন্দ্রিক যৌথ বাহিনীতে পরিণত করার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ।
সামরিক বিশ্লেষক ওয়াং ইউনফেই টাইপ ১০০-এর প্রবর্তনকে পিএলএ-র সক্ষমতার ক্ষেত্রে এক যুগ-নির্ধারক পরিবর্তন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একটি বিস্তৃত যুদ্ধ নেটওয়ার্কের নোড হিসেবে কাজ করে এই ট্যাঙ্কগুলি ডেটা শেয়ার করতে পারে। অন্যান্য সামরিক শাখার সাথে সমন্বয় সাধন করতে পারে, যার ফলে তারা দূরপাল্লার ফায়ার মিশন পরিচালনা করতে এবং সামগ্রিক কার্যকারিতা বাড়াতে সক্ষম।
টাইপ ১০০ ট্যাঙ্ক এমন কিছু ক্ষমতা ধারণ করে, যা সাধারণত বিমান এবং নৌবাহিনীর সাথে যুক্ত। রাডার, ইলেকট্রনিক নজরদারি সরঞ্জাম এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে সজ্জিত এই ট্যাঙ্কটি অপারেটরের দৃষ্টিসীমার বাইরের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে পারে। একটি সম্মিলিত-অস্ত্র ব্যাটালিয়নের তত্ত্বাবধায়ক কমান্ডার ইউয়ান উল্লেখ করেছেন, পিএলএ এখন অন্যান্য সামরিক শাখা থেকে রিয়েল-টাইম সহায়তা আহ্বান করতে পারে, যা আধুনিক সামরিক বাহিনীর সমন্বিত যৌথ অপারেশনাল ক্ষমতার উদাহরণ।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থলবাহিনীর জন্য দৃষ্টিসীমার বাইরে অপারেশন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, যার জন্য রাডার এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমগুলির ক্ষুদ্রাকরণ প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে চীনের সাম্প্রতিক অগ্রগতি এটিকে সত্যিকারের দূরপাল্লার স্থলযুদ্ধে সক্ষম হাতেগোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে। এই অর্জন সামরিক প্রযুক্তিতে চীনের ক্রমবর্ধমান দক্ষতা এবং বৈশ্বিক সামরিক কৌশলগুলির উপর এর সম্ভাব্য প্রভাবকে তুলে ধরে।
টাইপ ১০০ ট্যাঙ্কের প্রবর্তন বৈশ্বিক সামরিক গতিশীলতার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে। দূরপাল্লার যুদ্ধ ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে চীন তার কৌশলগত বিকল্পগুলিকে বাড়িয়ে তোলে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করে। এই উন্নয়ন অন্যান্য দেশকে তাদের সামরিক কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করতে এবং সমতা বজায় রাখার জন্য অনুরূপ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করতে পারে।
দূরপাল্লার যুদ্ধ এবং সমন্বিত যৌথ অপারেশন দ্বারা চিহ্নিত যুদ্ধের এই বিবর্তনশীল প্রকৃতি ঐতিহ্যবাহী সামরিক মতবাদগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে এবং প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার জন্য নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন তৈরি করছে। দেশগুলি যখন এই পরিবর্তনগুলির সাথে নিজেদের মানিয়ে নেবে, তখন মূল অঞ্চলগুলিতে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসতে পারে, যা নতুন জোট এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দেবে। টাইপ ১০০ ট্যাঙ্কের ক্ষমতা ভবিষ্যতের সামরিক সংঘাতগুলিকে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল