মাদকের নেশায় জড়িয়ে ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া রাজশাহীর পবা উপজেলার দিনমজুর মিনারুল ছিলেন জুয়া ও মাদকে আসক্ত। উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামনশিকড় গ্রামে এ ঘটনা ঘটে ১৫ আগস্ট। মোহনপুরের কৃষক আকবর শাহ পানবরজ দেখিয়ে ১৩টি এনজিও থেকে ৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। পানের দরপতনে ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলেন না। ১৮ আগস্ট পানের বরজে মেলে তার নিথর দেহ।
বামনশিকড় গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কোনো না কোনো সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন। ওই এলাকার এক যুবক বলেন, মাদক আর কার্ড খেলা এই গ্রামের ধ্বংসের মূল কারণ। নেশার টাকা জোগাড় করতে না পেরে এনজিও থেকে ঋণ নেয়। কিস্তি দিতে না পেরে তছনছ করে ফেলে নিজেদের জীবন। আরেক নারী বলেন, ‘আমার স্বামী দিনে অন্তত ২০০ টাকার নেশা করে। তার আয় গড়ে ৩০০ টাকা। স্বামীর ইনকামের ১০০ টাকা দিয়ে নিজের সংসার চলবে, নাকি ঋণ শোধ করবে?
১৮ আগস্ট জেলার মোহনপুর উপজেলার খাড়ইল গ্রামের পানবরজে আকবর শাহ (৫০) নামের কৃষকের ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন। ১৬ জুলাই পবার নওহাটা কলেজ মোড় এলাকার ছাত্রাবাসে শামসুদ্দিন (৩২) নামে অটোরিকশাচালক আত্মহত্যা করেন। ১৪ আগস্ট মোহনপুরের বেলনা গ্রামের রিকশাচালক ফজলুর রহমানকে (৫৫) হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে পরদিন তার মৃত্যু হয়। স্বজনদের দাবি, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযুক্ত ধুলুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ দুর্গাপুর উপজেলার শ্যামপুর গ্রাম থেকে রেন্টু পাইক (৫০) নামে এক কৃষকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। সেদিন তার ৫ হাজার টাকা কিস্তি দেওয়ার কথা ছিল। দিতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। বামুনশিকড় গ্রামে আড়াইশ পরিবারের বসবাস। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেয় তারা। গ্রামীণ ব্যাংক, টিএমএসএস, আশা, ব্র্যাক, কারিতাস, শাপলা গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা ও শতফুলসহ বেশ কিছু এনজিও এখানে কাজ করছে।
ঋণ থাকলেও ঋণ : দুর্গাপুরে আত্মহত্যা করা কৃষক রেন্টু পাইকের বাড়ি থেকে ১৮টি এনজিওর পাসবই উদ্ধার করে পুলিশ। অর্ধেকের ঋণ পরিশোধিত থাকলেও বাকিগুলোর ঋণ চলমান ছিল। মোহনপুরে আত্মহত্যা করা পানচাষি আকবর শাহের বাড়িতে তার স্ত্রীর নামে পাওয়া গেছে ১১টি সংস্থার পাস বই। দফায় দফায় এসব সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন আকবর।
টাকা আদায়ে চাপ : রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলামের ঋণ আছে। তিনি বলেন, একদিন কিস্তি দিতে দেরি হলে এনজিওর লোকেরা বাড়ি এসে বসে থাকে। স্ত্রী-সন্তানদের হত্যার পর আত্মহত্যা করা মিনারুল ইসলামের চাচি জানেহার বেগম বলেন, মিনারুল কিস্তির চাপে ঠিকমতো বাড়িতেই থাকতে পারত না।
ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশন (আরআরএফ) নামে এনজিওর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন জহুরুল ইসলাম (৫৫)। বিদেশে গিয়ে ছেলে দুর্ঘটনায় পড়লে দুটি কিস্তি দিতে পারেননি। মাঠকর্মীরা বাড়িতে গিয়ে চাপ দিচ্ছিলেন। রাজশাহী শহরে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে আত্মগোপন করেন। ২৯ এপ্রিল জহুরুলকে খুঁজে বের করেন আরআরএফের কর্মীরা। অপমান করেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতেই। তখন বানেশ্বরে এনজিওর কার্যালয়ে গিয়ে জহুরুল বলেছিলেন, এভাবে চাপ দিলে আত্মহত্যা ছাড়া তার পথ থাকবে না। তাতেও মন গলেনি কর্মকর্তাদের। পরে ঘাস মারা বিষ কিনে এনজিও কার্যালয়েই পান করেন জহুরুল। সপ্তাহখানেক হাসপাতালে থাকলেও এখনো তিনি সুস্থ হতে পারেননি। টিএমএসএস খড়খড়ি শাখার ম্যানেজার মশিউর রহমান বলেন, মিনারুল ইসলাম প্রায় এক বছর আগে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। ৩০ কিস্তি পার হওয়ার পর সবাই দ্রুত পরিশোধের জন্য আগ্রহী হলেও তার ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন হয়। তাকে ফোন করা হলে বলেন, অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে মেডিকেলে আছি। মাত্র ২ হাজার ২০০ টাকার মতো জের থাকায় ও মেয়ে অসুস্থ বলে তাকে আর টাকার বিষয়ে বলা হয়নি। পরে হঠাৎ তার মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছি। ব্র্যাকের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মোতারফ হোসেন বলেন, যারা ঋণ নিয়ে সঠিকভাবে ব্যবহার না করে, অন্য খাতে ব্যয় করে তার জন্য উঠে দাঁড়ানো সত্যিই কঠিন। চাপ দেওয়ার কথা সঠিক নয়।
মনিটরিং নেই : রাজশাহীতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনে সক্রিয় ৭১৩টি ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থা। তাদের কার্যক্রম নিয়ে কোনো তথ্য নেই জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে। একই অবস্থা সমবায় কার্যালয়েরও।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ঋণগ্রহীতার বাড়িতে খাবার বন্ধ থাকলেও পরিশোধ করতে হয় ঋণের কিস্তি। এসব এনজিওর কার্যক্রম এবং ঋণের খাত নিয়ে মনিটরিং নেই। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, যেকাজের জন্য ঋণ নেওয়া হয়, সেকাজে অর্থ ব্যয় না করে মানুষ অন্য কাজে ব্যয় করছে। ফলে একটার ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আরেকটা সংস্থা থেকে বা ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণ নিচ্ছে। এগুলোর মনিটরিং না থাকায় গ্রামে গ্রামে মানুষ ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে।
পবার পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মুর্শেদ বলেন, আমার এলাকায় ৩০-৩৫টি এনজিও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এরা কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেটা সংশ্লিষ্টদের দেখা উচিত।
রাজশাহীর মানবাধিকার সংগঠন বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টার নির্বাহী পরিচালক ফয়েজুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ঋণ নেওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পর থেকেই কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হয়। এতে ঋণের টাকা ব্যবহার বা বিনিয়োগের সুযোগ পান না। ফলে ঋণ নিয়ে লাভ হয় না। সুদের হার ১৪ শতাংশ বলে প্রচার করা হলেও বাস্তবে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। এটা প্রতারণা। এ বিষয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির মনিটরিং বাড়াতে হবে। তবে অথরিটির দাবি, দুই প্রক্রিয়ায় সুদ নেয় এনজিওগুলো। এতে সাড়ে ১২ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত হয়।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন বলেন, ব্যবসা দাঁড় করাতে গেলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটা একক কোনো এনজিও দেয় না। ফলে মানুষ একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নেন। সঠিকভাবে বিনিয়োগ হলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যখন ঋণের টাকার অপব্যবহার হয়, তখনই সেটা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা এনজিওগুলোকে পরামর্শ দিয়ে থাকি, তারা যেন যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয়। অনেকের একাধিক এনজিওতে ঋণ থাকে। এটা কমিয়ে আনতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মির্জা ইমাম উদ্দিন বলেন, বৈধ এনজিও ছাড়াও অনেকেই ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসন কঠোর হচ্ছে।