গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ স্বাক্ষর করেছে ২৫টি রাজনৈতিক দল। এ সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও করেছে দলগুলো। তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, বহুল আলোচিত এ জুলাই সনদ ভালো উদ্দেশ্যে করা হলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট ধূম্রজাল রয়েছে। এ সনদের অনেক ধারা বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি সনদে এমন কিছু ধারা আছে যা এরই মধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। গতকাল টেলিফোনে জানতে চাইলে এমন মতামতই দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের দুজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে গত দেড় দশক গণতন্ত্র ছিল না, আইনের শাসন ছিল না, মানবাধিকার ছিল না, গুম-হত্যা চলছে। বিগত গণ অভ্যুত্থান থেকে বোঝা গেছে জনগণ একটা পরিবর্তন চায়। জুলাই সনদ হয়তো জনগণের সেই পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা, সে উদ্দেশেই করা। কিন্তু এখনতো কোনো সংসদ নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। তিনি বলেন, জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো সই করেছে। এটি পাবলিকলি একটি চুক্তি। সেটি বাস্তবায়ন করবে জনগণ। ভোট দিয়ে মতামতও জানাবে জনগণ। এরপর যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাবে বা সরকার গঠন করবে সনদ বাস্তবায়ন তাদেরই দায়িত্ব। যারা বিরোধী দলে থাকবেন তাদের দায়িত্ব হবে সরকারকে সহযোগিতা করা। তবে জুলাই সনদকে কীভাবে সংবিধানে যুক্ত করা হবে আমার কাছে তা বোধগম্য নয়। ব্যারিস্টার খোকন বলেন, অতীতের বিতর্কিত ও জনবিরোধী বিষয়গুলো যেন আর ফিরে না আসে, জুলাই সনদের মাধ্যমে তার নিশ্চয়তা আদায় করে নিতে হবে। এজন্য দরকার জাতীয় ঐকমত্য, এর ভিত্তিতে সনদের বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ। তবে সব কিছুতেই আইনি ভিত্তি প্রয়োজন বিষয়টা এমনো নয়। ইংল্যান্ডের সিটিজেন চার্টার বা ম্যাগনাকার্টা সনদ, কিন্তু সংবিধান বা কোনো আইনগত আদেশের মাধ্যমে হয়নি বলেও জানান সুপ্রিম কোর্টের এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানুষের আস্থা সৃষ্টির জন্য এই সনদটা তৈরি করা হয়েছে। তবে যেটা হয়েছে তার মধ্যে একটা মিশ্রণ আছে। তিনি বলেন, আমরা তিনটা জিনিস পেয়েছি। প্রথমত, কিছু বিষয় এ সনদে এসেছে, প্রকৃতপক্ষে এই জিনিসগুলোর অস্তিত্বই নেই। অলরেডি সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছেন এমন বিষয় বাতিল করার কথাও বলা হয়েছে জুলাই সনদে। দ্বিতীয়ত, কিছু নিষ্পত্তি হওয়া বিষয়ও সনদে যুক্ত করা হয়েছে। হাই কোর্টের বেঞ্চ কোথায় থাকবে এটা রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত। এ বিষয়টিও সনদে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, এর বাইরে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এখানে কিছু ভালো বিষয়ও রয়েছে। ক্ষমতায় গেলে স্বৈরাচার হয়ে যাওয়া বা একক ইচ্ছায় রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে কিছু চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের কিছু প্রভিশন রাখা হয়েছে। তবে এটাও নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময় এ গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে তিনি বলেন, এই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে যথেষ্ট ধূম্রজাল রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যে ২৫টি দলের ৫০ জন নেতা সনদে স্বাক্ষর করেছেন, তাদের মধ্যে ৫ থেকে ৬ জন হয়তো সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন। এই পাঁচ-ছয় জন নেতা এটা সংসদে পাস করাতে পারবেন না। সংসদের ৩০০ এমপির অন্তত ২০০ জনের ভোট লাগবে পাস করাতে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অলরেডি বলা আছে, অর্থবিল ও সরকার পরিবর্তন ছাড়া সংসদ সদস্যরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে সরকার গঠন করা রাজনৈতিক দলের সব এমপি একই সিদ্ধান্তে ভোট দেবে সেটাও বলা যাবে না। মনজিল মোরসেদ বলেন, এ সনদ ভবিষ্যতে আদৌ কি হবে এটা এখনই বলার সুযোগ নেই। তবে এ সনদের মাধ্যমে অবশ্যই নির্বাচনে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। বলা হয়েছিল নির্বাচনের একটা সিঁড়ি জুলাই সনদ। অলরেডি সেই সিঁড়ি অতিক্রম করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের উদ্যোগটা ভালো হয়েছে। নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তারা যদি বাস্তবায়ন না করে, তাহলে এই রাজনৈতিক দলিলটি প্রকৃতপক্ষে মূল্যহীন হয়ে থাকবে বলেই মনে করেন এ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।