রাজধানী থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর ও প্রত্যন্ত এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে। এতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যেমন হতাহত হচ্ছেন, তেমনি অনেকের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক ও মানসিক চাপ। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা প্রায়ই হুমকি-ধমকি ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই, শটগান, ওয়াকিটকি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী ধরতে গিয়ে তাঁরা উল্টো হেনস্তা ও মারধরেরও শিকার হচ্ছেন। একের পর এক এসব ঘটনায় ভাঙছে পুলিশের মনোবল। এমনকি মাঠ পর্যায়ে অনেক বাহিনীর অনেক সদস্য হামলা, হেনস্তা ও বিদ্রুপের ভয়ে ইউনিফর্ম পরে যেখানে-সেখানে দায়িত্ব পালন করতে যেতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাড়ে ১৪ মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ সদস্যরা হামলা, হেনস্তা ও আক্রমণ থেকে রক্ষা না পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অপরাধ বিশ্লেষক ও সচেতন নাগরিকরা।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, চলতি বছরে গত ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পুলিশের ওপর হামলা, হেনস্তার ঘটনায় ৪৬২টি মামলা হয়েছে। সূত্র বলছে, মামলার চেয়ে প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা আরো বেশি। অনেকে বাহিনী ও নিজের আত্মসম্মানের কথা ভেবে ছোটোখাটো হামলার শিকার হলেও তা নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে চান না।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে একাধিক এলাকায় টহলরত বা দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় পুলিশের ওপর হঠাৎ আক্রমণ হয়েছে।
কিছু ক্ষেত্রে ডাকাত চক্র, কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী বা রাজনৈতিক সহিংসতায় যুক্ত ব্যক্তিরা এ হামলার পেছনে ছিল। এমনকি অটোরিকশাচালকদের হাতেও মারধর ও হেনস্তার শিকার হয়েছে পুলিশ। এসব টার্গেট করা হামলায় পুলিশ বাহিনীর ভেতরে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে একের পর এক ঘটনায় পুলিশের মনোবল নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভাঙবে রাষ্ট্রের সার্বিক সব শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাও।
তাই পুলিশের ওপর হামলা থামাতে এখনই প্রয়োজন কৌশলগত পুনর্বিন্যাস। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বারবার হামলার ঘটনা ঘটছে। এদিকে পুলিশের মনোবল ফেরাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেগুলোর দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলা চলে।
মাঠ পর্যায়ের এসআই থেকে শুরু করে এসপি পর্যন্ত অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা প্রায় একই উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, সম্প্রতি ‘মব’ সৃষ্টি করে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। আবার এসব ঘটনার কিছু ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। তবু হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। এসব ঘটনার পর পুলিশ নিজেরাই এখন নিরাপত্তাহীনতায় সময় পার করছে। ফলে তারা টহল দিতে কিংবা তল্লাশি চালাতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়েছে। তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে পুলিশের বিষয়ে শক্ত অবস্থান নেওয়ার বার্তা চান তাঁরা।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দীর্ঘ সময় পার হলেও পুলিশ তার মনোবল ফেরাতে পারেনি উল্লেখ করে টাঙ্গাইলের মাওলানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. উমর ফারুক বলেন, পুলিশের ওপর হামলার এসব ঘটনা শুধু বাহিনীর মনোবলেই নয়, সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি নাগরিক সমাজেরও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি তাদের মানসিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। মাঠ পর্যায়ে আধুনিক সুরক্ষা সরঞ্জাম, বডিক্যাম ও দ্রুত ব্যাকআপ ব্যবস্থার উন্নয়ন করলে হামলার ঝুঁকি অনেকটা কমানো সম্ভব।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা: গাজীপুরের টঙ্গীতে প্রধান সড়কে উঠতে না দেওয়ায় গত ৯ অক্টোবর মো. সাঈদ (৫০) নামের দায়িত্বরত এক ট্রাফিক পুলিশের মাথা ফাটিয়ে দেয় মো. মুস্তাকিন (৩৫) নামের এক অটোরিকশাচালক। পরে অভিযুক্তকে আটক করে পুলিশ। পরদিন ১০ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের জৈনাবাজারে মহাসড়কের মাঝখানে যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানোয় চালককে জরিমানা করায় হাইওয়ে পুলিশ কনস্টেবল আব্দুর রবকে (৪৫) মারধর ও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে বাসচালক, চালকের সহকারী (হেলপার) এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। গত ৪ অক্টোবর চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়া ৩০-৩৫ জন অতর্কিত নরসিংদীর পৌর শহরে অতিরিক্ত সহকারী পুলিশ সুপার শামিম আনোয়ারের ওপর হামলা চালিয়ে আহত করে দুই চাঁদাবাজকে ছিনিয়ে নেয় হামলাকারীরা। একই দিন বগুড়ার শিবগঞ্জে গ্রেপ্তারের পর হাতকড়াসহ আওয়ামী লীগ নেতা রেজ্জাকুল ইসলামকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাঁর সমর্থকরা।
এ ঘটনায় শিবগঞ্জ থানার এসআই আবদুল্লাহ আল মামুন বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরো ২০০-২৫০ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেছেন। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও রেলক্রসিং এলাকায় গাড়ি ছাড়তে দেরি হওয়াকে কেন্দ্র করে ট্রাফিক পুলিশের দুই সদস্যকে (এএসআই রবিউল হাসান ও কনস্টেবল রবিউল ইসলাম) মারধরের অভিযোগ উঠেছে এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। পরে তাঁকে আটক করা হয়।
এ ছাড়া সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থানার ওসি (তদন্ত) হাবিবুল্লাহ খান কোনো এক ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুলিশ হয়ে গেছে এখন বানরের মতো। রিকশাওয়ালার মার খায় পুলিশ। বানরের খাঁচায় বন্দি করে নাচাচ্ছে আমাদের। আমি অন্য চাকরির চিন্তা করছি।’
জানা গেছে, ঘরোয়াভাবে অনেক পুলিশ সদস্যের মধ্যে মানসিক চাপ, ক্লান্তি ও হতাশা বাড়ছে। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি এবং সামাজিক সমালোচনার মুখে অনেকেই পেশাগত অনুপ্রেরণা হারাচ্ছেন। একাধিক জেলায় কর্মরত কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যখন দেখি সহকর্মীরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন, তখন মনে ভয় কাজ করে। তবু কাজ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, এসব ঘটনায় বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। অনেকেই বলছেন, নিয়মিত ঝুঁকি মোকাবেলা করেও যখন হামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে, তখন মনোবলে প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন অপরাধীরা অনেক বেশি সংগঠিত। পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর প্রবণতা বাড়ছে। এটি উদ্বেগের বিষয়।’
সাম্প্রতিক হামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করে দায়ীদের আইনের আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলেন, হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরো বাড়তে পারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা ও হেনস্তার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। তবু বাংলাদেশ পুলিশ মনোবল অটুট রেখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বদ্ধপরিকর। এসব ঘটনার তদন্ত চলছে, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ জনগণের আস্থা ও নিরাপত্তা রক্ষায় পেশাদারিত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে।
এদিকে সম্প্রতি পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে উল্লেখ করে এসব ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠন দুটির মতে, একটি কুচক্রীমহল সুপরিকল্পিতভাবে পুলিশের মনোবল দুর্বল করতে ইউনিফর্মধারী পুলিশকে পেশাগত কাজে বাধা দেওয়া এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও বেআইনি ঘটনা শুধু পুলিশ বাহিনীর জন্য নয়, রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্যও হুমকিস্বরূপ। পুলিশের বৈধ দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া, হামলা বা লাঞ্ছনার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, নিন্দনীয় ও দুঃখজনক।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/মুসা