দেশের বেসরকারি খাতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বলেছেন, ক্যাশলেস সোসাইটি গঠন এখন সময়ের দাবি। প্রতিটি লেনদেন ডিজিটাল হলে তার ট্রেস (চিহ্ন) থাকে, ফলে অর্থ পাচার, দুর্নীতি ও অনিয়ম অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আসে। একই সঙ্গে নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকের বিপুল ব্যয়ও কমে যাবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু পুবালী ব্যাংকেরই বছরে ২৪০ কোটি টাকা খরচ হয় নগদ অর্থ ব্যবস্থাপনায়।
এই অর্থ সাশ্রয় করে গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারদের জন্য বাড়তি সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও নগদ ব্যবস্থাপনায় বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাই সব মিলিয়ে ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলা সবার জন্যই উপকারী।
পুবালী ব্যাংকের এমডি বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা প্রসারে পুবালী ব্যাংক ইতোমধ্যে দুটি অ্যাপ চালু করেছে রিটেইল গ্রাহকদের জন্য ‘পাই’ এবং করপোরেট ও এসএমই গ্রাহকদের জন্য ‘পাই করপোরেট’। মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা রিটেইল, করপোরেট ও সিএমএসএমই সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা অ্যাপের মাধ্যমে দিতে চাই।
মার্চেন্ট গ্রাহকদের জন্য গত বছর ১ লাখ কিউআর কোড সরবরাহ করেছি, এ বছর আরও বাড়বে। দোকানগুলোতে ১২ হাজারের বেশি পয়েন্ট অব সেল মেশিনও স্থাপন করা হয়েছে।
মোহাম্মদ আলী জানান, গ্রাহক যেন ব্যাংকে এসে কাউন্টারে না গিয়ে নিজেই সেবা নিতে পারেন, সেজন্য ব্যাংক সেলফ সার্ভিস ব্যাংকিং কর্নার তৈরির কাজ করছে। প্রতিটি কর্নারে থাকবে আরটিডিএম (রিয়েল টাইম ডিপোজিট মেশিন), সিআরএম (ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন) এবং কিয়স্ক। কিয়স্কের মাধ্যমে গ্রাহকদের বায়োমেট্রিক ও ছবি নেওয়া হবে। এতে গ্রাহক অ্যাপ, এটিএম বা বুথে গিয়ে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে নিরাপদভাবে লেনদেন করতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা এমন এলাকাতেও ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ তৈরি করতে চাই যেখানে ব্যাংকিং সুবিধা সীমিত। এজন্য প্রত্যন্ত গ্রামেও এটিএম বুথে কাস্টমার সার্ভিস অফিসার থাকবে গ্রাহককে সহায়তা করতে।
পুবালী ব্যাংকের এমডি বলেন, বর্তমানে আমাদের ব্যাংকের পাই অ্যাপের সক্রিয় ব্যবহারকারী সংখ্যা ১০ লাখ, যা ব্যাংকের মোট গ্রাহকের প্রায় ১০ শতাংশ। এদের অধিকাংশই তরুণ প্রজন্ম। আমরা আশা করছি, আগামী দুই বছরের মধ্যে আরও ৪০ লাখ গ্রাহক অ্যাপে যুক্ত হবেন। তখন ১ কোটি গ্রাহক পাই অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন করবেন, এটিই আমাদের লক্ষ্য, বলেন মোহাম্মদ আলী।
তিনি জানান, বর্তমানে অ্যাপের মাধ্যমে বছরে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। আগামী বছরে তা ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি। পাই অ্যাপ থেকে টাকা পাঠানো, বিল পরিশোধ, ডিপিএস, এফডিআর খোলা-বন্ধ, স্টেটমেন্ট ডাউনলোডসহ সব সেবা পাচ্ছেন।
মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, আমরা গ্রাহকদের উৎসাহ দিতে পাই অ্যাপে সব ধরনের লেনদেন চার্জমুক্ত করেছি। এতে নগদের চাপ কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি নেটওয়ার্ক চার্জও মওকুফ করে, তাহলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে।
ক্যাশলেস সমাজের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন ডিজিটাল শিক্ষা ও সচেতনতাকে। প্রতারকরা ফোন বা বার্তার মাধ্যমে প্রতারণা করার চেষ্টা করে। তাই গ্রাহককে অনবোর্ড করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সচেতন করতে হবে, বলেন মোহাম্মদ আলী। এমডি বলেন, ব্যাংক নিয়মিতভাবে সোশ্যাল মিডিয়া, ফোন ও এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহক সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সার্ভার ও ডাটাবেজ সুরক্ষা এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণেও জোর দেওয়া হচ্ছে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে এক সময় সমস্যাগ্রস্ত একটি ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন পুবালী ব্যাংক দেশের শীর্ষ মুনাফা ও কর্মীবান্ধব ব্যাংকগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। জাতীয়করণের পর আবারও বেসরকারি খাতে ফিরে এসে আধুনিক ব্যাংকিং সেবায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে যেখানে গড় খেলাপি ঋণের হার ৩৩ শতাংশ, সেখানে পুবালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে। খেলাপি ঋণ এক ধরনের রোগের মতো। অনেক ব্যবসায়ী ভাবেন, অন্যরা ঋণ শোধ না দিলে আমিও না দিয়ে পার পেয়ে যাব। কিন্তু পুবালী ব্যাংক শুরু থেকেই এই প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর।
মোহাম্মদ আলী বলেন, পুবালী ব্যাংকের ব্যালেন্সশিট এখন ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমানত বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। আমরা দেশের অন্যতম শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছি। ডিজিটাল রূপান্তর, গ্রাহকবান্ধব নীতি ও সততার সঙ্গে ব্যাংকিং এই তিন মূলনীতিই আমাদের সাফল্যের ভিত্তি। ক্যাশলেস সোসাইটি, গ্রাহক সচেতনতা, ডিজিটাল ব্যাংকিং ও নিরাপত্তার সমন্বয়ে পুবালী ব্যাংক এগিয়ে যাচ্ছে নতুন যুগের ব্যাংকিংয়ের পথে। তাই ক্যাশলেস সোসাইটি শুধু ব্যাংকের নয়, এটা দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ।