বাংলাদেশের নাটক ও সিনেমার ইতিহাস ঘাঁটলে স্পষ্ট বোঝা যায়, দীর্ঘদিন এ মাধ্যমগুলোতে পুরুষ চরিত্রই ছিল কেন্দ্রবিন্দু। নারী চরিত্র অনেকাংশে আবর্তিত হয়েছে মা, প্রেমিকা কিংবা স্ত্রী হিসেবে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই চিত্র হয়েছে পরিবর্তিত। আমাদের নাটক, ওটিটি ও সিনেমায় এমন কিছু নারীর উপস্থিতি ঘটেছে, যাঁরা শুধু গল্পের প্রয়োজনেই আসেননি, তাঁরা সমাজের প্রতিচ্ছবি, প্রতিরোধ আর অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। কখনো মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে, কখনো শহরের অফিস-আদালতের বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আবার কখনো নিজের স্বপ্ন বা মর্যাদার জন্য দাঁড়িয়েছেন দৃপ্তকণ্ঠে।
নবিতুন [সারেং বউ, ১৯৭৮]
সিনেমায় গ্রামের মোড়লের ষড়যন্ত্রে বিদেশে থাকা স্বামী কদমের কাছ থেকে সারেং বাড়ির বউ নবিতুনকে (কবরী সারোয়ার) আলাদা করার নানা ঘটনা চলতে থাকে। স্বামীর দেওয়া টাকা গোপনে হাত করে নেয় মোড়ল। এরপর চলতে থাকে নবিতুনের সংগ্রাম। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর এই বেঁচে থাকার এবং নতুন সমাজ গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্প বলে ‘সারেং বউ’।
জয়গুন [সূর্য দীঘল বাড়ি, ১৯৭৯]
ক্ল্যাসিক সিনেমা ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র জয়গুন (ডলি আনোয়ার) চরিত্রটিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কুসংস্কার ও পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার একক লড়াই এখনো দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
শিমু ভাবি [এই সব দিনরাত্রি, ১৯৮৫]
ডলি জহুর অভিনীত শিমু ভাবি শুধুই গৃহিণী ছিলেন না, সংসারকে যেভাবে চালিয়েছেন, তা অনেকের কাছে ছিল এক আদর্শ নারীর প্রতীক।
হুরমতি [সংশপ্তক, ১৯৮৮]
ফেরদৌসী মজুমদার অভিনীত ‘হুরমতি’ এখনো বাংলাদেশের নাটক ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী চরিত্র। বিত্তবানদের লালসার শিকার হয়েও যখন রমজানের কান কেটে দেয়, তখন সে হয়ে ওঠে এক প্রতিরোধের প্রতীক।
মুনা [কোথাও কেউ নেই, ১৯৯০]
বাকের ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক, তার মৃত্যুর পর জেলগেটে দাঁড়িয়ে ‘বাকের আমার কেউ না’-এই সংলাপ আজও মানুষের চোখে জল আনে। সুবর্ণা মুস্তাফার মুনা চরিত্র ছিল আবেগ আর আত্মমর্যাদার অসাধারণ সংমিশ্রণ।
রানু [অয়োময়, ১৯৯০]
হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘অয়োময়’ নাটকে রানু (নাজমা আনোয়ার) চরিত্রটি ছিল একজন শিক্ষিত, সচেতন ও দৃঢ়চেতা নারী। যিনি নারীর আত্মপরিচয়ের প্রতিনিধি।
বুড়ি [হাঙর নদী গ্রেনেড, ১৯৯৭]
গ্রামের প্রতিবাদমুখর দুরন্ত কিশোরী বুড়ির বিয়ে হয় গফুরের সঙ্গে। গফুরের আগের ঘরের দুই সন্তানকে বুড়ি ভালোবাসলেও নিজের সন্তান চাইত সে। অনেক সাধনার পর যে সন্তান বুড়ি পায়, সে হয় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। এর মাঝে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এক ছেলে চলে যায় যুদ্ধে, আরেক ছেলেকে বুড়ির সামনে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। কিন্তু বুড়ি ভয় পায় না। বুড়ি বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে তার নিজের সন্তানকে তুলে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে। নিজ সন্তানকে বলি দিয়ে বুড়ি হয়ে ওঠে পুরো একটি দেশের মা।
রুবা হক [থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, ২০০৯]
রুবা হক, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। যিনি একা এক নারী। নিজের পথে নিজের সিদ্ধান্তে চলা নারীর বাস্তব চিত্র।
বিলকিস বানু [গেরিলা, ২০১১]
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’তে জয়া আহসান অভিনীত বিলকিস বানু চরিত্রটি এক সাহসী নারীর জীবনের প্রতিচ্ছবি। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর নিজে গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। পরিণতিতে ধরা পড়লেও নিজের শরীরকে বোমায় পরিণত করে মিলিটারি ক্যাম্প উড়িয়ে দেন।
আয়েশা [ন’ডরাই, ২০১৯]
কেন্দ্রীয় চরিত্র আয়েশা (সুনেরাহ বিনতে কামাল) একজন সার্ফার। বাংলাদেশের প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থার চোখ রাঙানি, পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করে সে এগিয়ে যায় নিজের স্বপ্নের পথে। এই চরিত্রটি বাস্তব সার্ফার নাসিমা আক্তার থেকে অনুপ্রাণিত। এটি কেবল একটি নারীর সাহসিকতার গল্প নয়, বরং নারীর আত্মপ্রকাশের রূপরেখা।
শিমু [মেড ইন বাংলাদেশ, ২০১৯]
গার্মেন্ট কর্মী শিমু (নিকিতা নন্দিনী) চরিত্রটি নারীর শ্রম অধিকার আদায়ের এক জীবন্ত দলিল। শিমু কেবল নিজের অধিকারের কথা বলে না, বরং শ্রমিকদের সংগঠিত করে একটি ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে নারীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত এই সিনেমা নারী স্বাধীনতার এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
সাবিলা [লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, ২০২১]
সাবিলা চরিত্রটি (ফারিণ) কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, সমাজের বিচারহীনতা এবং পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একজন নারীর অবিচল লড়াইকে প্রকাশ করে।
রেহানা [রেহানা মরিয়ম নূর, ২০২১]
আজমেরী হক বাঁধনের অনবদ্য অভিনয়ে ফুটে ওঠা রেহানা চরিত্রটি একজন মেডিকেল কলেজ শিক্ষিকা, যিনি একজন সহকর্মীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা প্রতিবাদ করে। সামাজিক ও পেশাগত চাপে থেকেও রেহানার নির্ভীক অবস্থান আমাদের বলে দেয়- নারী যদি চায়, তবে সে পারে।
ফাতিমা [ফাতিমা, ২০২৪]
তাসনিয়া ফারিণ অভিনীত চরিত্র ফাতিমা, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন ধর্ষণের শিকার এক নারী এবং একই সঙ্গে এক আধুনিক নারীর আত্মপরিচয়ের খোঁজের যাত্রী। সাবিলা চরিত্র আজকের শহুরে নারীর প্রতিবাদী মুখ।