‘১৯৯৩ সালে তোজাম্মেল হক বকুল এলেন তাঁর বাসায়। বললেন, ‘আপা, ছবির নাম বদলাতে চাই। রাখব ‘‘পাগল মন’’।’ নতুন করে গানটি রেকর্ড করলেন দিলরুবা। বকুল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘ছবি হিট হলে একটা গাড়ির চাবি দেব।’ ছবি হিট হলো, আকাশছোঁয়া সাফল্য পেল। কিন্তু গাড়ির চাবি আর এলো না।’
দিলরুবা খান, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যিনি একটি মাত্র গান দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে উচ্চারিত এক নাম। সেই গান ‘পাগল মন’। কণ্ঠে এক অদ্ভুত মায়া, কথায় এক অজানা ব্যথা। কিন্তু এই গানের পেছনে যে গল্প, তা যেন কোনো সিনেমার চেয়ে কম নয়-রোমাঞ্চে, হতাশায়, আবার বিস্ময়ে ভরা।
এক দুপুরের অজানা আগমন
দিলরুবার কথায়, ‘ঊনত্রিশ বছর আগে এক দেবদূত এসে আমাকে দিলরুবা থেকে ‘‘পাগল মন’’ বানিয়েছিল।’ ১৯৯০ সালের শেষ দিকের এক দুপুরে তাঁর বাসায় এলেন দুই অচেনা লোক। হাতে একটা কাগজ-কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লেখা কিছু লাইন, ‘কে বলে পাগল, সে যেনো কোথায়... রয়েছো কতই দূরে...’। লোক দুজনের চোখেমুখে বিনয়। একটিই অনুরোধ, ‘আপা, এই গানটা আপনি গাইবেন?’ দিলরুবার ভ্রু কুঁচকালো। ‘না না, এসব কী কথা! পাগল মন, ঘোড়া দৌড়ায়-এ গান আমি গাইব না।’ কিন্তু অনুরোধের টান বড় অদ্ভুত জিনিস। ওরা ছিল আহমেদ কায়সার, পাগল মন গানের গীতিকার। আর আশরাফ উদাস, যিনি সুরটা করেছিলেন। সুরকার আশরাফ উদাস বললেন, ‘আপা, আমি ভালো সুর করেছি। আপনি যদি রেডিওতে গানটা করেন, তাহলে আমি একটা টেপ রেকর্ডার পাব। ওটা আমার খুব দরকার।’ মানুষের চোখের অনুরোধে মায়া জাগে। দিলরুবা খান রাজি হলেন। গাইলেন ‘পাগল মন’, রেডিওর জন্য। তিনি জানতেন না, সেটাই তাঁকে বাংলাদেশের গানপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী করে দেবে।
রেডিও থেকে স্টেজ, স্টেজ থেকে ঝড়
গানটি প্রচারের পর কিছুদিন কেটে যায় নিরিবিলি। তারপর একদিন, এক স্টেজ প্রোগ্রামে গিয়ে অবাক হলেন দিলরুবা। দর্শকরা একসঙ্গে চিৎকার করছে, ‘পাগল মন!’ তিনি গাইলেন। জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ল। তারপর যেন ঝড় বয়ে গেল। যেখানেই গেলেন, সেই এক গান, ‘পাগল মন শুনতে চাই!’ তখনই তাঁর মনে হলো, এবার অ্যালবাম করার সময় এসেছে।
ডন মিউজিক আর সেই ১ কোটির গল্প
১৯৯২ সালের কথা। দিলরুবা গেলেন ডন মিউজিকের বাবুল চৌধুরীর কাছে। তিনি বললেন, ‘অ্যালবাম বের করব, তবে টাকা দিতে পারব না।’ দিলরুবা রাজি। শুধু অনুরোধ করলেন, ‘মিউজিকের খরচটা দিন।’ সেভাবেই আলী আকবর রুপুর সংগীত আয়োজনে তৈরি হলো অ্যালবাম ‘পাগল মন’। আর ইতিহাস গড়া শুরু হলো সেখান থেকেই। দেশের গ্রামগঞ্জ থেকে রাজধানী, এমনকি প্রবাস পর্যন্ত-সব খানেই বাজতে লাগল সেই গান। ডন মিউজিকের হিসাব বলছে, অ্যালবাম বিক্রি হয়েছিল দেড় কোটি কপি পর্যন্ত। দিলরুবার নিজের বিশ্বাস, কম করে হলেও ১ কোটি। তখন এক ক্যাসেটের লাভ ছিল ৮ টাকা। মানে প্রায় ৮ কোটি টাকা মুনাফা! কিন্তু অর্থ নয়, মানুষের ভালোবাসাই তাঁর কাছে ছিল আসল সম্পদ। ‘টাকা-পয়সার মোহ আমার নেই। দেশবাসী আমাকে চিনেছে, এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।’
যখন গান হলো সিনেমা
১৯৯৩ সালে পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল এলেন তাঁর বাসায়। তখন তিনি ‘এই জানের জান’ নামে একটি সিনেমা করছেন। বললেন, ‘আপা, ছবির নাম বদলাতে চাই। রাখব ‘‘পাগল মন’’।’ নতুন করে গানটি রেকর্ড করলেন দিলরুবা। বকুল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘ছবি হিট হলে একটা গাড়ির চাবি দেব।’ ছবি হিট হলো, আকাশছোঁয়া সাফল্য পেল। কিন্তু গাড়ির চাবি আর এলো না। দিলরুবা খান বলেন, ‘ছবিটি ৫ কোটি টাকার মুনাফা করেছিল, কিন্তু এক প্যাকেট মিষ্টিও দেননি।’ তবু তাঁর কণ্ঠে তিক্ততা নেই, আছে শান্তি।
পাগল মনের উত্তরাধিকার
এরপর ডি জে রাহাত যখন গানটি নতুন করে করতে চাইলেন, দিলরুবা অবাক হলেও খুশি হয়েছিলেন। যদিও এবারও কোনো পারিশ্রমিক পাননি, তবু তাঁর কণ্ঠের মায়া থেকে গেছে আগের মতোই, অমলিন।
এক গান, এক পরিচয়
‘আমার নাম তো দিলরুবা থেকে পাগল মন হয়ে গেল’ বলতে বলতে হেসে ফেলেন তিনি। একসময় বাবার কাছে গাইতে গেলেই ঝাড়ু হাতে তাড়া খেতেন, আজ সেই বাবা-ই তাঁর গান গেয়ে বেড়ান। ফেসবুকে কেউ ভালোবাসায় ভরিয়ে দেন, কেউ ধমকায়, ‘এই গানটা কেন গাইলেন আপনি?’ হয়তো এটাই সংগীতের জাদু। একটি গান, যা কণ্ঠ ছাড়িয়ে একসময় জীবনের গল্প হয়ে যায়।