নব্বই দশক, বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের সোনালি সময়। যে সময়ে তরুণরা গিটার কাঁধে তুলে নিয়েছিল এক অন্য রকম স্বপ্নের গান। সেই সময়ের গান মানে কেবল সুর নয়, ছিল এক ধরনের জীবনবোধ, প্রতিবাদ, প্রেম, বেদনা আর আশার প্রতিধ্বনি। এখন সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, কিন্তু সেই গানগুলোর আবেদন আজও মুছে যায়নি। এখনো রাতের নিঃশব্দ সময় কিংবা দীর্ঘ যাত্রাপথে সেই সুরগুলোই বাজে-‘চলো বদলে যাই’, ‘একাকী’, ‘নিঃস্ব করেছো আমায়’, ‘মেলায় যাইরে’ কিংবা ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’।
গুরু আজম খান : পথপ্রদর্শক
বাংলা ব্যান্ড সংগীতের জনক বলা হয় আজম খানকে। তাঁর ‘আমি যারে চাইরে’, ‘আলাল ও দুলাল, ‘পাপড়ি’ কিংবা ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’- দেশপ্রেম, ভালোবাসা আর আত্মমর্যাদার প্রতীক। আজম খানের গান শুধু শোনার জন্য নয়, অনুভবের জন্য।
আইয়ুব বাচ্চু : কষ্ট থেকে চলো বদলে যাই
নব্বই দশকের ব্যান্ড সংগীতের আকাশে এক উজ্জ্বল নাম আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর কণ্ঠে এলআরবি মানেই ছিল যন্ত্র আর অনুভবের জাদু। ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘সেই তুমি’, ‘রুপালি গিটার’, ‘এক আকাশের তারা তুই’ কিংবা ‘সুখের এ পৃথিবী’-এ গানগুলো যেন এক এক জীবন। তাঁর গিটারের সুরে প্রেমের সঙ্গে মিশেছিল সময়ের একাকীত্ব, তরুণ প্রজন্মের না পাওয়া। ‘চলো বদলে যাই’ কেবল একটি গান নয়, এটি ছিল এক যুগের চেতনা, পরিবর্তনের আহ্বান। আর ‘মেয়ে’-প্রেমের ভাষায় এক অমলিন ক্ল্যাসিক।
জেমস : নগর বাউলের চিরন্তন মায়া
যদি কেউ বলেন, জেমস মানেই নস্টালজিয়া- তা অমূলক নয়। তাঁর কণ্ঠের খাঁটি কাঁচা রক, মাদকতার মতো ছড়িয়ে ছিল তরুণদের মধ্যে। ‘তারায় তারায়’, ‘হতেও পারে এ দেখা’, ‘বাবা’-এ গানগুলো আজও হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। ‘বাবা’ গানে জেমস এক আবেগঘন গল্প বলেছেন, যা প্রতিটি প্রজন্মকে স্পর্শ করেছে। আর ‘আমার সোনার বাংলা’-রক ঢঙে সেই জাতীয় গানের উপস্থাপন আমাদের গর্বিত করে এখনো।
শাফিন আহমেদ ও মাইলস : এখনো আধুনিক
শাফিন আহমেদের কণ্ঠে মাইলসের গান মানেই এক অনন্য আবেগ। ‘নিঃস্ব করেছো আমায়’, ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি’, ‘জন্মদিন তোমার’ কিংবা ‘কী জাদু তোমার প্রেমে’-সবই ছিল শহুরে প্রেম আর এক ধরনের গ্ল্যামার মিশ্রিত ব্যথার প্রতীক। মাইলস ব্যান্ডের সাউন্ড যেন আজও আধুনিক, সময় পেরিয়েও গানগুলো নতুন মনে হয়।
হাসান-টুলু-পঞ্চম ও আর্ক : জীবনের মিষ্টি-কষ্টের গল্প
‘এতদিন পর প্রশ্ন জাগে’-শুধু একটি গান নয়, এক দীর্ঘ অপেক্ষার যন্ত্রণার প্রতীক। হাসানের কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত মায়া, যা ‘সুইটি’, ‘এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়’, ‘একাকী’ গানগুলোকে আজও শ্রোতার হৃদয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। অন্যদিকে কি-বোর্ডিস্ট ও ব্যান্ডের মূল কান্ডারি আশিকুজ্জামানের কণ্ঠে গাওয়া ‘এই দূর পরবাসে’, ‘রেশমী জ্যোৎস্না’, ‘ওরে আমার পাগল মন’সহ অনেক গান এখনো সবার মুখে মুখে ফেরে। তিনি গীতিকার-সুরকার হিসেবে সমান সমাদৃত। অন্যদিকে রিদওয়ান নবী পঞ্চমের কণ্ঠের ‘আকাশের নীলে’, হারালে কোথায়’, ‘এমন একটা সময় ছিল’ যেন কালজয়ী গান হয়ে ভক্তদের মাঝে বেঁচে আছে।
মেজবাহ ও ডিফারেন্ট টাচ : বৃষ্টিভেজা বিকেলের সুর
‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’-এই গানটি শুনলেই মনে হয়, যেন ছাদে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ পড়ছে। ‘দৃষ্টি প্রদীপ জ্বেলে’-অন্য এক আলোর যাত্রা। মেজবাহর ডিফারেন্ট টাচ ছিল ব্যান্ড সংগীতের কাব্যিক দিকের প্রতিনিধি।
মাকসুদ ও ফিডব্যাক : মেলার আনন্দে-স্মৃতিতে
‘মেলায় যাইরে’, ‘মনে পড়ে তোমায়’, ‘মৌসুমি’-এই তিনটি গানেই মাকসুদের কণ্ঠে পাওয়া যায় জীবনের এক রঙিন মেলবন্ধন। ফিডব্যাক ব্যান্ড যেন শহুরে জীবনের আনন্দ-বেদনার সাউন্ডট্র্যাক।
তপন চৌধুরী ও সোলস : মন ছুঁয়ে যাওয়া সুর
‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’, ‘কী এমন পরিচয়’-তপন চৌধুরীর কণ্ঠে সোলস যেন এক নরম সুরের প্রেমপত্র। নরম সুরেও রক হতে পারে গভীর ও শ্রুতিমধুর।
টিপুর অবসকিউর : মাটির গন্ধ, রাতের আবেশ
‘ছাইড়া দিলাম মাটির পৃথিবী’, ‘নিঝুম রাতের আঁধারে’, ‘মাঝরাতে চাঁদ যদি’-এই গানগুলো গ্রামীণ আবহ আর আধুনিক সংগীতের চমৎকার সংমিশ্রণ। টিপুর কণ্ঠে যে সুর, তা হৃদয়ে বাজে অনেকক্ষণ।
চাইম ব্যান্ডের খালিদ : সাইফ ও জুয়েলে মুগ্ধতা
খালিদের কণ্ঠে ‘নাতি খাতি বেলা গেল’, ‘কোন কারণে ফেরানো গেল না’, হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের ‘সে দিনের এক বিকেলে’ কিংবা সাইফের ‘কখনো জানতে চেও না’- এই গানগুলো হয়তো প্রচারের আলো তেমন পায়নি, কিন্তু শ্রোতার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।
এক প্রজন্মের নস্টালজিয়া, আজও জীবন্ত
নব্বই দশকের এই ব্যান্ড সংগীত আমাদের শেখায়- সুর বদলায়, সময় বদলায়, কিন্তু ভালো গানের মৃত্যু হয় না। আজও ইউটিউবে লাখো মানুষ শোনে সেই গানগুলো। ফেসবুকে কেউ লিখে- ‘এই গানটা আমার শৈশব।’ এই সোনালি সময় শুধু সংগীতের নয়, ছিল আমাদের জীবনেরও সোনালি দিন। তাই আজও যখন বাজে, ‘চলো বদলে যাই’- তখন মনে হয়, সময় থেমে গেছে এক মুগ্ধ সন্ধ্যায়, যেখানে গিটার আর কণ্ঠ মিলেমিশে তৈরি করেছিল বাংলাদেশের সেরা সংগীত অধ্যায়।