বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাল্লা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাড়ি জমাচ্ছেন ধনী ব্যক্তিরা। আগের বছরগুলোর তুলনায় এ সংখ্যা নজিরবিহীনভাবে বাড়ছে বলে জানিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স।
প্রতিষ্ঠানটির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্তের কোটিপতিরা উল্লেখযোগ্যভাবে আরব আমিরাতে পাড়ি জমাবেন। এ সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৯ হাজার ৮০০ জনে, যা বিশ্বের যেকোনও দেশের চেয়ে বেশি।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বিশেষ করে দুবাই শহর দীর্ঘ সময় ধরে আশপাশের দেশের ধনীদের স্বাগত জানিয়ে আসছে। তবে এখন পশ্চিমা দেশগুলো থেকেও এখানে পাড়ি জমানো কোটিপতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
কিন্তু এর পেছনে কারণ কী? কেন, গোটা বিশ্ব থেকে পাল্লা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছেন ধনী ব্যক্তিরা?
জানা গেছে, দুবাইসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোথাও আয়কর দিতে হয় না। এছাড়াও বর্তমান বিশ্বের অন্যান্য শহরে বিলাসী জীবনযাপন করা দিন দিন প্রায় কঠিন হয়ে পড়ছে, অথচ সংযুক্ত আরব আমিরাতে সহজেই এমন জীবনধারা উপভোগ করা যায়।
পাশাপাশি আরব আমিরাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা বেশ কড়া। দেশটি ধনীদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অপরাধের নিম্নমুখী হার, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ও অবাধ বিলাসিতার সুযোগ থাকায় দেশটি কোটিপতিদের কাছে জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
ধনী ও দক্ষ বিদেশিদের টানতে আরব আমিরাত গোল্ডেন ভিসা চালু করেছে। এই ভিসার মাধ্যমে ১০ বছরের আবাসিক মর্যাদার সুযোগ পাওয়া যায়।
দুবাইয়ে স্থানান্তরে কাজ করছে আরেকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্কাইবাউন্ড ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান মাইক কোডি বলেন, তার অনেক গ্রাহক মনে করেন- এখন নিজ দেশে সফল হওয়া যেন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার মতে, নিজ দেশে ধনীদের ওপর একদিকে যেমন কর ও নজরদারি বাড়ানো হয়, সে অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। বরং সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক কমিয়ে দেওয়া হয়। অথচ দুবাইয়ে সম্পদ লুকানোর কিছু নেই; বরং সম্পদশালী হওয়া স্বাভাবিক বিষয়।
কোডি আরও বলেন, “লন্ডনে আমার গ্রাহকেরা ফিসফিসিয়ে নিজেদের সম্পদের কথা বলেন। তবে দুবাইয়ে তারা মুক্তভাবে বাঁচতে পারেন।”
বিলাসী ইনফ্লুয়েন্সারদের শীর্ষ গন্তব্যও এখন দুবাই। এখানে আছে বড় বড় শপিং মল, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন ও কৃত্রিম দ্বীপ ‘দ্য পাম’—যেখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে সারি সারি পাঁচতারকা হোটেল।
যদিও দুবাই শহর নিয়ে সমালোচনাও আছে। স্বল্প বেতনের অভিবাসী শ্রমিকদের ঘামঝরানো পরিশ্রমে এখানকার অর্থনীতি টিকে আছে। কিন্তু সেখানে এসব শ্রমিক ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হন বলেও বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নেই
দুবাইসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা খুবই কম। বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নেই বললেই চলে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্কাইবাউন্ড ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের প্রধান মাইক কোডি বলেন, তার গ্রাহকদের বেশির ভাগই ৩০ থেকে ৪০ বছরের পেশাজীবী। তাদের কেউ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, কেউ পারিবারিক ব্যবসায় জড়িত, কেউ আবার পরামর্শক ও ফান্ড ম্যানেজার।
এমনই একজন একটি ক্লাউড সফটওয়্যার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। ৪২ বছর বয়সী ওই ধনী ব্যক্তি নিজের কোম্পানি বিক্রির মূলধনি মুনাফার কর থেকে বাঁচতে যুক্তরাজ্য থেকে আরব আমিরাতে পাড়ি জমিয়েছেন।
ধনী ব্যক্তিদের দেশ ছাড়ার দিক থেকে বর্তমানে শীর্ষে আছে যুক্তরাজ্য। দেশটি থেকে ‘নন-ডম’ স্ট্যাটাসধারীদের অনেকেই এখন পাড়ি জমাচ্ছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ‘নন-ডম স্ট্যাটাস’ বলতে বোঝায়, যুক্তরাজ্যে থাকলেও যাদের স্থায়ী নিবাস ভিন দেশে।
একসময় এসব মানুষকে যুক্তরাজ্যে তাদের বৈদেশিক আয়ের ওপর কর দিতে হতো না। এখন তারা দেশটিতে কঠোর করনীতির মুখে পড়ছেন।
করসংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি উত্তরাধিকারবিষয়ক নীতিতে কড়াকড়ি ও ধন–বৈষম্য নিয়ে উচ্চবাচ্যের কারণে যুক্তরাজ্য চলতি বছর রেকর্ড ১৬ হাজার ৫০০ কোটিপতি হারাতে চলেছে বলে জানিয়েছে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স।
চলতি বছর যুক্তরাজ্য ছেড়ে আরব আমিরাতে পাড়ি জমানো কোটিপতিদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি জন ফ্রেডরিকসেন। নরওয়ের গণমাধ্যমে তিনি বলেন, “যুক্তরাজ্য নরকে পরিণত হয়েছে।” তাই তিনি আরব আমিরাতে পাড়ি জমিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে দুবাইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন প্যাডকো রিয়েল এস্টেটের প্রধান নির্বাহী ম্যাক্স ম্যাক্সওয়েল।‘বিল্ডিং ওয়েলথ উইদাউট বর্ডারস’ পডকাস্টে এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা সবাই নিজেদের পছন্দসই একটা জীবনধারার খোঁজে থাকি।”
পরিবারসহ আমিরাতে পাড়ি জমানোর পর এই উদ্যোক্তা দেখেছেন, একই অর্থ ব্যয় করে সেখানে তার পরিবার আগের চেয়ে ভালো জীবনযাপন করতে পারছে।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের দুবাই অফিসের ফিলিপ আমারান্তে বলেন, ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদ ও বিলাসী জীবনধারা ধরে রাখতে চান। তারা ব্যবসার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও চান না। এ ক্ষেত্রে আরব আমিরাতের বার্তা স্পষ্ট। দেশটি জানিয়েছে, তারা ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত।
কোডি বলেন, “আমার গ্রাহকদের কাছে সংযুক্ত আরব আমিরাত যেন একেবারে যুৎসই জায়গা।”
রিয়েল এস্টেট গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নাইট ফ্রাঙ্কের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের প্রধান ফয়সাল দুররানি বলেন, ধনী পরিবারগুলো শুধু বসবাসই নয়, এখন তাদের ব্যবসা আর ব্যক্তিগত অফিসও দুবাইয়ে নিয়ে আসছে, যা আগে দেখা যায়নি।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি কোটিপতি আছে, বিশ্বের এমন ২০টি শহরের একটিতে পরিণত হয়েছে দুবাই। শহরটিতে বর্তমানে ৮১ হাজার ২০০ কোটিপতি ও ২০ জন শতকোটিপতি বসবাস করেন।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্যমতে, গত বছর দুবাইয়ে এক কোটি ডলার বা এর বেশি মূল্যের ৪৩৫টি বাড়ি বিক্রি হয়েছে। অথচ নিউইয়র্ক ও লন্ডনে যৌথভাবে এর চেয়ে কম বিক্রি হয়েছে। উচ্চমূল্যের সম্পত্তির বাজারে এটিই এখন সবচেয়ে ব্যস্ততম শহর। পশ্চিমা দেশের তুলনায় আরব আমিরাতে এসব সম্পত্তি তুলনামূলক সস্তা।
দুররানি বলেন, “মোনাকো আর সুইজারল্যান্ডের ক্রেতারা আমাদের কাছে ১০ কোটি ডলারে দুবাইয়ে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে চান। কিন্তু দুবাইয়ে ওই দামে পুরো একটি ভবন কেনা সম্ভব।” সূত্র: ফ্রান্স২৪, এনডিটিভি, এএফপি
বিডি প্রতিদিন/একেএ