বাংলাদেশে সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত দেশীয় বাংলা ধারাবাহিক নাটকের জনপ্রিয়তা থাকলেও নব্বইয়ের শেষ দিকে এসে তা দর্শক হারায়। এর কারণ, মানের অভাব ও পর্যাপ্ত কনটেন্ট নেই। বর্তমান সময়ের দেশীয় নাটক ও ধারাবাহিকগুলোতে প্রমিত শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে কমছে। এর পরিবর্তে প্রায় নাটকে ব্যবহার করা হচ্ছে আঞ্চলিক ও অশ্লীল ভাষা। একই সঙ্গে নাটকের নামও কৌলীন্য হারাচ্ছে। এসব কিছুই আমাদের দেশের সংস্কৃতিবিরুদ্ধ। তা ছাড়া টিভি নাটক ও ধারাবাহিক হচ্ছে ড্রইংরুমের বিনোদন। যেখানে বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্কসহ সব শ্রেণি ও বয়সের মানুষ একসঙ্গে বসে অনুষ্ঠান দেখে। সেক্ষেত্রে যদি এমন রুচিহীন নাটক ও ধারাবাহিক প্রচার করা হয় তাহলে তা কীভাবে পরিবার নিয়ে দর্শক দেখবে? তা ছাড়া দেশি কনটেন্টের মূল্য বেড়েই চলেছে এবং এগুলোর মান না থাকায় কমছে স্পন্সর। ফলে নব্বই দশকের শেষ দিকে এসে দেখা যায় এ দেশের টিভি চ্যানেলে ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাব। প্রায় এক দশক ধরে বাংলার প্রতিটি ঘরে এসব ভারতীয় নাটক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে সেই স্থান দখলে নিয়েছে বাংলায় ডাবিংকৃত তুর্কি, ইরানি, কোরিয়ানসহ অন্যান্য দেশের সিরিজ। ২০১৫ সাল থেকেই বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল দীপ্ত টিভি শুরু করে তুর্কি ধারাবাহিকের প্রচার। ‘সুলতান সুলেমান’ নামে একটি তুর্কি ধারাবাহিক নাটক বাংলায় ডাবিং করে প্রথম প্রচার করে চ্যানেলটি। ইতিহাসভিত্তিক এ ধারাবাহিকটি সম্প্রচারের পর রাতারাতি সাড়া পড়ে যায়। কয়েক মাসের মধ্যে সিরিয়ালটি দেশের টিভি অনুষ্ঠানমালার তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে। এরপর দেশের অন্য টেলিভিশন চ্যানেলেও একাধিক তুর্কি সিরিয়াল প্রচার শুরু হয়। যার প্রায় সবই দর্শকপ্রিয়তা পায়। শুধু তাই নয়, টিভি চ্যানেলগুলোর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি পেইড ভার্সন ওটিটি প্ল্যাটফর্মও এসব সিরিয়াল মুক্তি দিতে থাকে। এতে দেখা যায়, ভারতীয় সিরিয়াল থেকে মানুষ সরে এসে টেলিভিশন ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ভিন্ন ঘরানার এসব তুর্কি ও অন্য দেশের সিরিয়ালের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। যার ফলে টিভি চ্যানেলে এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দর্শক সংখ্যা বাড়তে থাকে। মানসম্মত প্রযোজনা এবং তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের উপস্থিতির ফলে এগুলো দর্শকদের মন জয় করছে। তুরস্কের ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঘটনা অবলম্বনে ঐতিহাসিক নাটক ‘দিরিলিস : আরতুগ্রুল’, ষোড়শ শতাব্দীর অটোমান সাম্রাজ্যের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘সুলতান সুলেমান’ এবং সামাজিক নাটক ‘বাহার’; এ প্রতিটি ধারাবাহিক বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ধরনের বিদেশি অনুষ্ঠানের ডাবিং ও প্রযোজনার কাজটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও এগুলোতে নিজস্ব ছোঁয়া আনতে টিভি চ্যানেল ও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে বড় অঙ্কের অর্থ ও সময় বিনিয়োগ করতে হয়। দীপ্ত টিভির এজিএম মারিয়াম হক জানান, ২০১৫ সালে ‘সুলতান সুলেমান’ দুটি ভিন্ন সময়ে প্রচার হতো। সেটি ছিল সে সময় বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা অনুষ্ঠান। এর টিআরপি রেটিং ছিল ২। দুবার সম্প্রচার হিসাবে ধরলে টিআরপি রেটিং ৩ হয়। এ ধারাবাহিকগুলো বাংলাদেশে কেন এত জনপ্রিয়? উত্তরে তিনি বলেন, উঁচু বাজেটের প্রযোজনা এবং এগুলোর কাহিনির আকর্ষণ, মানসম্মত নির্মাণশৈলী, প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার।
তা ছাড়া বিদেশি ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি এ দেশের মানুষের প্রচুর আগ্রহ রয়েছে। মারিয়াম হক আরও বলেন, আসলে দর্শকপ্রিয়তার জন্যই দীপ্তসহ অন্য টিভি চ্যানেলগুলো বিদেশি সিরিয়াল ডাবিং করে প্রচার করছে। তিনি বলেন, আশির দশকে বিটিভিতে প্রচারিত জনপ্রিয় ভারতীয় সিরিয়াল ‘আলিফ লায়লা’ প্রচারের দীর্ঘ সময় পর ২০১৫ সালে দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত ‘সুলতান সুলেমান’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ‘সুলতান সুলেমান’ ধারাবাহিকের ইব্রাহিম পাশার কণ্ঠদাতা মোহাম্মদ মোর্শেদ সিদ্দিক বলেন, ‘তুর্কি ধারাবাহিকগুলো শুধু বিনোদনই দেয়নি, একই সঙ্গে শিশুদের প্রমিত বাংলা শিখতে সাহায্য করেছে। আমরা এমনভাবে কথাগুলো বলি, যাতে মনে হয় কবিতা আবৃত্তি করছি। টিভি ধারাবাহিকের ডাবিংয়ের জন্যই বেসরকারি চ্যানেলের দর্শক বেড়েছে।’ বাংলাদেশের বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, যেমন- বিঞ্জ ও বঙ্গ বিডিও বাংলায় ডাবিং করা তুর্কি এবং অন্যান্য দেশের সিরিজ ও সিনেমা নিয়ে এসেছে। এগুলোর জনপ্রিয়তা এ দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে সর্বাধিক তুর্কি ধারাবাহিক প্রচার করেছে দীপ্ত টিভি। ‘সুলতান সুলেমান’ ছাড়াও চ্যানেলটি প্রচার করেছে রোমান্টিক কমেডি ধারাবাহিক ‘তুমি আছ সবখানে’। এ ছাড়া ‘সূর্যকন্যা’, ‘ভালোবাসা ফিরে এলো’, ‘গুড ডক্টর’, ‘দিরিলিস : আরতুগ্রুল’, ‘বাহার’, ‘ফাতমাগুল’, ‘সুলতান সুলেমান : কোসেম’, ‘ফেরিহা’, ‘জননী জন্মভূমি’ ইত্যাদি। দর্শকপ্রিয়তার তালিকায় রয়েছে এনটিভিতে প্রচারিত ‘কুরুলুস : উসমান গাজী’ নামের ধারাবাহিকটিও। এ ছাড়া এশিয়ান টিভিতে প্রচারিত তুর্কি ‘আয়েশা মরিয়ম’ সিরিজটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ ছাড়া দেশি চ্যানেল ও ওটিটিতে প্রচারিত বেশ কটি জনপ্রিয় বিদেশি সিরিজের মধ্যে রয়েছে ‘হাতিম তায়ি’, ‘টিয়ারস অব হ্যাভেন’, ‘কারবালা কাহিনী’, ‘নূরজাহান’, ‘জান্নাত’, ‘ইউসুফ-জুলেখা’, ‘মোস্তফা’, ‘হায়াত-মুরাত’ প্রভৃতি। এদিকে গতকাল থেকে বাংলাভিশন টিভি চ্যানেলে প্রচার শুরু হয়েছে জনপ্রিয় তুর্কি ধারাবাহিক ‘সুলতান আবদুল হামিদ’।