জুটি প্রথা এ উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে খুবই নিয়মিত এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অনেক চলচ্চিত্রের নাম বলা যাবে যার সাফল্যের পেছনে জুটিই সেরা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে নায়ক-নায়িকার জুটিই। তবে নায়ক-নায়িকার বাইরে বড়পর্দা মাতিয়েছে নায়কদের জুটিও। অর্থাৎ এক ছবিতে একাধিক নায়কের অভিনয়। এ জুটি যেমন একটি চলচ্চিত্রকে তারকাবহুল করে তেমনি অনেক তারকার ক্যারিয়ারের উত্থানের সহায়কও হয়। ঢাকাই চলচ্চিত্রে এ নায়ক জুটির তালিকা বেশ লম্বা, আর সাফল্যের ইতিহাসটাও সমৃদ্ধ। বহু নায়ক সমসাময়িক কিংবা জুনিয়র-সিনিয়র নায়কদের সঙ্গে একাধিকবার জুটি বেঁধে পর্দায় সাফল্য পেয়েছেন। ষাট-সত্তর দশকের সময়টাতে স্বর্ণযুগ ছিল চলচ্চিত্রের। সোনালি যুগ ছিল নায়কদের জুটিরও। এ সাফল্যের তালিকায় সবার আগেই আনতে হয় ‘জিঞ্জির’ সিনেমার নাম। দীলিপ বিশ্বাস পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। এতে তৎকালীন সুপারস্টার নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছিলেন হার্টথ্রব দুই নায়ক আলমগীর ও সোহেল রানা। তিন নায়কের অনবদ্য অভিনয়ে ছবিটি আজও ইতিহাস হয়ে আছে। সেই ছবির সাফল্য আজও নায়ক জুটির জন্য অনুপ্রেরণার। এরপর এই তিনজনকে আবার দেখা গেছে ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া এফ আই মানিক পরিচালিত ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’ ছবিতে। আরও জনপ্রিয় ছবি উপহার দিয়েছেন রাজ্জাক-আলমগীর। তারা ‘গুন্ডা’ ‘অন্ধ বিশ্বাস’, ‘স্বামী-স্ত্রী’, ‘অগ্নিকন্যা’, ‘রজনীগন্ধা’ ইত্যাদি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। ববিতার সঙ্গে রাজ্জাক-আলমগীর হাজির হয়েছিলেন সত্তরের দশকে ইবনে মিজান পরিচালিত সুপারহিট সিনেমা ‘লাইলী মজনু’-তে। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গুন্ডা’ ছবির পর রাজ্জাক-কবরী-আলমগীর এই তিন তারকাকে আবার দেখা গিয়েছিল ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘তুমি আমার স্বামী’ চলচ্চিত্রে। ছবিটি মোটামুটি ব্যবসা করেছিল। হিট ছবি দিয়েছে রাজ্জাক-বুলবুল আহমেদ জুটিও। তাদের ‘বদনাম’, ‘সেতু’, ‘সোহাগ’, ‘ঘর সংসার’, ‘বৌরানী’, ‘রাজলক্ষী শ্রীকান্ত’, ‘অঙ্গার’ ছবিগুলো মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। আর রাজ্জাক-ফারুককে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল সত্তরের দশকে মুক্তি পাওয়া নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘এরাও মানুষ’ ছবিতে। আশির দশকে রাজ্জাক পরিচালিত ‘অভিযান’ ছবিতে একসঙ্গে দেখা যায় রাজ্জাক-জসিম-ইলিয়াস কাঞ্চনকে। ২০১৬ সালে আবার এ জুটিকে দেখা যায় এফ আই মানিক পরিচালিত ‘কোটি টাকার কাবিন’ ছবিতে। এরপর উদাহরণ হিসেবে টানা যায় নায়ক উজ্জলের নাম। এ নায়ক জুটি বেঁধেছেন নায়করাজ রাজ্জাক ও ফারুকের সঙ্গে। রাজ্জাকের সঙ্গে উজ্জলের ‘বন্ধু’ ছবিটির সাফল্য ছিল আকাশছোঁয়া। এটি ছিল ১৯৬৭ সালের ছবি। উজ্জল বেশকটি ছবিতে জুটি বেঁধেছেন মিয়াভাই খ্যাত ফারুকের সঙ্গে। তাদের দেখা গেছে ‘দোস্তি’, ‘কারণ’, ‘ফুলেশ্বরী’ ইত্যাদি সুপারহিট চলচ্চিত্রে। এ ছাড়াও উজ্জল জুটি বেঁধেছেন বুলবুল আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবালের সঙ্গে। তবে চিত্রনায়ক ফারুক ও জাফর ইকবালের ‘বন্ধু আমার’ সিনেমাটি নায়কদের জুটির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। বন্ধুত্বের অসাধারণ গল্পের সেই ছবিটিতে কিংবদন্তি হয়ে আছে অন্ধ ফারুক ও বন্ধু প্রিয় জাফর ইকবালের অভিনয়ের আলোয়। সেই সঙ্গে ছবিতে বাপ্পী লাহিড়ীর কণ্ঠে ‘বন্ধু আমার’ গানটিও হয়েছে কালজয়ী। বন্ধুত্ব নিয়ে এর চেয়ে সুন্দর, আবেগী গান এখনো হয়নি বলে মন্তব্য করেন অনেকেই। এরপর ফারুকের সঙ্গে জাফর ইকবাল অভিনয় করেছেন ‘জবাব চাই’ ও ‘ভুল বিচার’ নামের ব্যবসাসফল সিনেমাতে। এ ছাড়াও জাফর ইকবাল জুটি বেঁধে সফল হয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক, আলমগীর, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চনদের সঙ্গে। ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে জাফর ইকবালের ‘শিকার’, ‘ভাই বন্ধু’ ছবি সুপারহিট ছিল। রাজ্জাক ও জাফর ইকবাল জুটি অভিনীত আশির দশকে মুক্তি পাওয়া গাজী মাজহারুল আনোয়ার পরিচালিত ‘সন্ধি’ ছবিটি আজও সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে। সত্তরের দশকে মুক্তি পাওয়া দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করে সোহেল রানা ও ওয়াসিম সেরা নায়ক জুটি হয়ে আছেন। ঢাকাই ছবিতে গড়ে উঠেছিল নায়কদের আরও একটি জুটি। সেটি ইলিয়াস কাঞ্চন ও সোহেল চৌধুরীর। খুব বেশি সিনেমাতে অভিনয়ের সুযোগ তারা পাননি। তবে ‘মহান বন্ধু’ ও ‘প্রতিশোধের আগুন’র মতো হিট ছবিগুলো নায়কদের জুটির তালিকায় শক্ত অবস্থান দেয় কাঞ্চন-সোহেলকে। একটা সময় এসে খুব বেশি দেখা যেত জুনিয়র-সিনিয়র নায়কদের জুটি। এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, সবচেয়ে সফল ছিলেন আলমগীর-ইলিয়াস কাঞ্চন। বেশকটি ছবিতে তাদের একত্রে দেখা গেছে ভাই, শালা-দুলাভাই, প্রেমিক ও প্রেমিকার বাবা চরিত্রে। নব্বই দশকের শুরুর দিকে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন অনেক নায়কই। বয়সে বা অভিজ্ঞতায় তারা কাঞ্চনের চেয়ে ছোট হলেও সিনেমাতে হাজির হতেন গুরুত্ব নিয়েই। তাদের মধ্যে কাঞ্চনের সঙ্গে ‘ভাংচুর’ ছবি দিয়ে দর্শক মাতিয়েছেন রুবেল। ওমর সানীকে দেখা গেছে ‘মোনাফেক’, ‘গোলাগুলি’সহ আরও বেশ কিছু ছবিতে। তবে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জুটি বেঁধে অভিনয় করা নায়কটির নাম অমিত হাসান। তারা একসঙ্গে ‘আত্মত্যাগ’, ‘দয়াবান’, ‘আমি এক অমানুষ’, ‘জবর দখল’, ‘বেঈমানী’, ‘অপরাজিত নায়ক’, ‘অবাধ্য সন্তান’, ‘আত্মবিশ্বাস’ ইত্যাদি ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন। ত্রিভুজ প্রেমের ছবিতে নায়কদের জুটির জয়জয়কার দেখা যায় নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে। যার শুরুটা হয়েছিল ওমর সানী-বাপ্পারাজ, অমর নায়ক সালমান শাহ ও রিয়াজের হাত ধরে। তাদের ‘হারানো প্রেম’, ‘প্রেমগীত’, ‘প্রিয়জন’ ছবিগুলো তুমুল ব্যবসাসফল হয়েছিল। এ ছাড়া এই দুই নায়ককে দেখা গিয়েছিল ‘কথা দাও’ ছবিতে। ‘প্রিয়জন’ ছবিতে দুই নায়ক সালমান ও রিয়াজ। এ সিনেমার মধ্য দিয়েই আবারও ফিরে এসেছিল ত্রিভুজ প্রেমের সিনেমার রাজত্ব। ‘প্রিয়জন’ একটি নতুন ইন্ডাস্ট্রির, নতুন রসায়নের আভাস দিয়েছিল। এর সাফল্যের পর বেশ কিছু ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন সালমান-রিয়াজ। কিন্তু সালমানের অকালমৃত্যু থমকে দেয় অনেক ইতিবাচক ভাবনা। পরবর্তীতে সেসব ছবিতে রিয়াজের সঙ্গে দেখা গেছে অন্য নায়কদের। সালমানের মৃত্যুর পর রিয়াজ-শাকিল খান হাজির হন রোমান্টিক গল্পে ত্রিভুজ প্রেমের দুর্দান্ত রসায়ন নিয়ে। তারা পরপর উপহার দিলেন ‘নারীর মন’, ‘বিয়ের ফুল’, ‘মন’ নামের সুপারহিট ছবি। এসব ছবি নায়ক জুটি হিসেবে শক্ত অবস্থান গড়ে দিয়েছিল রিয়াজ-শাকিলকে। এরপর তারা ‘সাথী তুমি কার’, ‘তোমাকেই খুঁজছি’সহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রে কাজ করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। রিয়াজের সঙ্গে জুটি বেঁধে সফল হয়েছেন আমিন খানও। তাদের ‘হৃদয়ের বন্ধন’, ‘লাল দরিয়া’ ছবিগুলো বেশ দর্শক টেনেছিল। রিয়াজের সঙ্গে সাফল্য পেয়েছেন ফেরদৌসও। তাদের ‘এই মন চায় যে’, ‘বস্তির মেয়ে’ ছবিগুলো ছিল ব্যবসাসফল। তবে রিয়াজ-শাকিল ও ফেরদৌসকে একসঙ্গে হাজির করে চমক দেখিয়েছিলেন নির্মাতা মোস্তাফিজুর রহমান মানিক। ‘দুই নয়নের আলো’ নামের ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেন তারা। শাকিব খানও তার ক্যারিয়ার গড়েছেন সিনিয়র নায়কদের সঙ্গে জুটি বেঁধে। বিশেষ করে রিয়াজের সঙ্গে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’, ‘স্বপ্নের বাসর’ ছবি দুটি শাকিব খানের ক্যারিয়ারে সবুজ বাতি জ্বালিয়েছিল। এরপর তারা ‘নষ্ট’ ও ‘বাধা’ ছবিতেও অভিনয় করেছেন।
এ ছাড়াও শাকিব খান সাফল্য পেয়েছেন ফেরদৌস, আমিন খান, আলেকজান্ডার বো’দের সঙ্গে। এ ছাড়া আমিন খানকে নিয়ে ‘সাগরিকা’ এবং রিয়াজকে নিয়ে ‘আশা আমার আশা’র মতো হিট ছবি উপহার দিয়েছিলেন হেলাল খান। আর বাপ্পারাজ-অমিত জুটি উপহার দিয়েছিলেন ‘ভুলো না আমায়’, ‘পাগলীর প্রেম’ নামে সুপারহিট ছবি। তবে এই জুটির সেরা ছবি হয়ে আছে ‘প্রেমের সমাধি’। তাদের একসঙ্গে আরও দেখা গেছে ‘চাকরানী’, ‘প্রেমের নাম বেদনা’ ছবিতেও। বাপ্পারাজ জুটি বেঁধে সফল হয়েছেন রিয়াজের সঙ্গেও। তাদের ‘বুক ভরা ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা কারে কয়’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’ ছবিগুলো তুমুল ব্যবসাসফল ছিল। মান্নার সঙ্গে জুনিয়র নায়ক হিসেবে জুটি বেঁধে সফল ছিলেন শাকিব খান, শাহীন আলম, মেহেদী, মারুফসহ আরও অনেকেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দিনে দিনে নায়কদের জুটি প্রথা হারিয়েই যাচ্ছে। নিজের ক্যারিয়ার শক্ত হওয়ার পর শাকিব অন্য কোনো নায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে ছবি করা থেকে বিরত থেকেছেন। সিনিয়র বা জুনিয়র- কোনো প্রজন্মের নায়কদের সঙ্গেই তিনি অভিনয় করতে চান না। যদিও রাজি হন সেখানে দেখা যায় অন্য নায়কের চরিত্রটির গুরুত্ব বলতে কিছু নেই। তাই প্রতিষ্ঠিত অন্য নায়করাও আগ্রহ দেখান না তার সঙ্গে অভিনয় করতে। ফলে বড়পর্দার এই নায়ক জুটি প্রথা বলতে গেলে থেমেই গেছে।